‘এরোগীর যা অবস্থা খুব খারাপ এক ঘণ্টা বাঁচবে কি না সন্দেহ আছে। দ্রুত বেসরকারি হাসপাতালে না নিলে পথিমধ্যে রোগী মারা যাবে। এমন অনেক দেখেছি ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার আগেই মারা গেছেন।’— এভাবেই ঢাকার বাইরে গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পথে টঙ্গী পার হলেই রোগীর স্বজনদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। পরে চালকের চুক্তি করা উত্তরা ও টঙ্গী এলাকায় অবস্থিত হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করানো হয়। উত্তরায় শিনশিন জাপান, রেডিকেল, আর্ক, লেকভিউ, আরএমসিসহ সব হাসপাতালে দালাল হিসেবে কাজ করে চালকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, রোগী প্রতি কমিশনে কাজ করে থাকি। আইসিইউতে রোগী ঢোকাতে পারলেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী নামিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ১৫-২০ হাজার টাকা দেয়। এভাবে ‘ঝুঁকিপূর্ণ নয়’— এমন রোগীর স্বজনদেরও ভয় দেখিয়ে উত্তরা ও টঙ্গীর প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাই।
২০১৯-২০ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায়, দেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের এক উদ্বেগজনক চিত্র সামনে উঠে আসে। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক চলছে কোনো ধরনের নিবন্ধন ছাড়াই। আরও ভয়ের বিষয় হলো— দেশের ৯০ ভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক, তাদের জন্য বেঁধে দেয়া ৭টি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত মধ্যে মাত্র ৩টি পূরণ করতে পেরেছে।
রাজধানীবাসী মানহীন-অনুমোদনহীন প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। এ সুযোগে চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এসব হাসপাতালে রোগী আনার জন্য রাখা হয়েছে দালাল চক্র। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো অ্যাম্বুলেন্সের চালক। সরকারি হাসপাতাল এলাকায় ঘাপটি মেরে থাকে এই চক্রের সদস্যরা। সরজমিন, ঢাকা মহানগরে দ্বিতীয় দফার অভিযানে বন্ধ করা ২০টি প্রতিষ্ঠানের ১৩টিতে গিয়ে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ফের খোলা দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘এদের সোজা পথে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আপনাদেরও বোকা বানানোর চেষ্টা করছে।’ অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘আপনি হয়তো অনেক এভিডেন্স দেখাতে পারেন। বন্ধের পর পর খুলে গেছে। হ্যাঁ এটা হয়েছে। যারা এটা করে তারা বেশ চতুর। কি করব অধিদফতরের তো ম্যাজেস্ট্রিসি নেই, পুলিশ নেই।’
ফারুক হোসেন। থাকেন রাজধানীর মিরপুর এলাকায়। তিনি বলেন, ‘গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা কান্দিরপাড় এলাকায়। অনিরাপদ রক্ত নেয়ার কারণে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস মিয়া দুই বছর আগে মারা যান। ফারুক হোসেন বলেন, ‘ক্যান্সার অপারেশনে ব্লিডিং হয়। রক্ত দেয়ার ফলে এইচবিএস পজিটিভে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যার জন্য দায়ী সেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, কুমিল্লা জেলায় অনুমোদিত ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা চারটি। এর বাইরেও রয়েছে একাধিক অনুমোদনহীন ব্লাড ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী রক্ত সংগ্রহ করতে হলে, রক্তের নমুনা এবং চিকিৎসকের চাহিদাপত্র থাকা বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে রক্তের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার পরই রক্ত দেয়া বা নেয়া যাবে। রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত শিনশিন জাপান হাসপাতালে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা নেয়ার আট মাস পার হলেও এখন পাগলের মতো অবস্থা লতিফ নামের এক রোগীর। কিন্তু হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতায় তার নাম লেখা হয় রফিক। মাথায় আঘাতের কারণে ভুলভাল বলছেন তিনি। চাকরি করতে না পেরে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন পরিবার নিয়ে। ভুল চিকিৎসার কারণে এ অবস্থা বলে দাবি পরিবারের। কিন্তু আঘাতের আগে গাজীপুরে পাকিজা নামের এক গার্মেন্টে কাজ করতেন তিনি।
লতিফের মা নাজমা বেগম বলেন, ভর্তির আগে আমাদের বলা হয়েছিল ৬০-৭০ হাজার টাকা লাগবে। কিন্তু ভর্তির এক সপ্তাহ পর রোগী নিয়ে যেতে চাইলে তারা বলেন বিল হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। পরে গার্মেন্ট ও মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে চার লাখ টাকা দিই। পরে আরও টাকা দাবি করেন। পরে আমরা টাকা ম্যানেজ করতে দেরি হলে ২৪ দিনে ৯ লাখ টাকা বিল করেন। রোগীকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন তারা। পরে নানা দেনদরবারের পরে মুক্তি মেলে। লতিফের পরিবার জানান, ১৩ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়ার পরে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। টঙ্গী আসার পরে অ্যাম্বুলেন্সের চালক বলেন, রোগীর অবস্থা যা খারাপ এক ঘণ্টা বাঁচবে কি না সন্দেহ। দ্রুত বেসরকারি হাসপাতালে না নিলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না।’ এরপর কৌশলে অল্প খরচে ভালো চিকিৎসার কথা বলে ভর্তি করান উত্তরার শিনশিন জাপান হাসপাতালে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ চিত্র শুধু শিনশিন জাপানেই নয়। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত উত্তরা আধুনিক কলেজ হাসপাতালে রোগী এলেই তারা নানা কৌশলে রোগী ভাগিয়ে উত্তরার বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করান। এ কাজ করে মাসে একটা মোটা অঙ্কের কমিশন পান তারা।
মেডিকেলের একটি সূত্র জানায়, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে ওয়ার্ড বয়ের মাধ্যমে প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী ভাগানোর কাজ চলে। গেটের সামনে দালালদের মহড়া। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে কমিশন ভিত্তিতে নানান কৌশলে ওয়ার্ড বয়দের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা রোগী ভাগানো হয়। উত্তরা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে অল্প খরচে চিকিৎসার কথা বলে চলে এ প্রতারণা। পরে চিকিৎসা শেষে গলা কাটা একটা বিল ধরিয়ে দেয় রোগীর স্বজনদের হাতে। বিল দিতে না পারলে অনেক সময় রোগীদের আটকেও রাখা হয়।
এ দালাল চক্রে রয়েছেন— জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মচারী সমিতির নেতা নজরুল ইসলাম। ওয়ার্ড বয় সাইদুল বাশার, আলামিন, সমির বৈদ্য, শামীম মিয়া ও ফারুক নানা কৌশলে সেখানে থেকে রোগী নিয়ে হাসপাতালের গেটের বাইরে থাকা বিভিন্ন হাসপাতালের দালাদের হাতে তুলে দেন। পরে দালালদের কাছ থেকে প্রতি রোগী অনুযায়ী নেয়া হয় কমিশন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জরুরি বিভাগ থেকে মূলহোতা ওয়ার্ড বয় সাইদুল বাশার রোগী ভাগানোর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে এবং জুনিয়র ওয়ার্ড বয়দের দিয়ে এই রোগী ভাগানোর কাজ করতে বাধ্য করায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির কিছু সদস্য এই রোগী পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমিতির সঙ্গে চুক্তি করেই জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড বয় থেকে রোগী নিয়ে যায় উত্তরার আশপাশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে। এর জন্য দালালরা উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতিকে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা দিতে হয় বলে দাবি করেন। রোগী ভাগাতে কেউ বাধা দিলে বা নিষেধ করলে তাদের বিভিন্ন প্রকার হুমকি ধমকি, মারধর ও হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ সংক্রান্ত সমিতির সদস্যসহ বেশ কিছু রোগীর দালালদের নামে রয়েছে মামলা। যেটি বর্তমানে পিবিআই তদন্তাধীন। এদের মধ্যে মূল দালাল লেকভিউ হাসপাতালের রাজু এবং রাজুর দুই ছেলে পলাশ ও সম্রাট। এরা হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় এবং সমিতির সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাসপাতাল থেকে নানান কৌশলে রোগী নিয়ে যায়।
জানতে শিনশিন জাপান হাসপাতালের পরিচালক বাবুর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
শিনশিন জাপান হাসপাতালের জি এম শরিফুর রহমান শরিফের কাছে ঘটনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং হাসপাতালের গেট বন্ধ করতে বলেন দারোয়ানকে। তিনি বলেন, ‘আমার হাসপাতালে যেটাই হোক কোনো সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবে না। যা পারেন করেন।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ