চিকিৎসাসেবা খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত মে’তে হঠাৎই অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বন্ধ করে দেয়া হয় আড়াই হাজারেরও বেশি অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ছয় মাস না পেরোতেই বন্ধ করে দেয়া বেশিরভাগ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ফের শুরু করেছে তাদের কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি— বন্ধ হওয়া ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ৯০ ভাগই এরই মধ্যে চালু হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে দিব্যি চলছে ব্যবসা।
নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিযানে বন্ধের সপ্তাহ পার হতেই কিছু কিছু ক্লিনিক নামের কসাইখানা সেবার নামে রোগীদের গলাকাটা শুরু করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আবার জানেই না যে তাদের হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বন্ধ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, টানা ৩ মাসের এই অভিযানে ঢাকা বিভাগে বন্ধ হয় ৪৭০ অনিবন্ধিত স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান। একই ভাবে চট্টগ্রামে ৪০৬টি, খুলনা বিভাগ ৪৯৭টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৫৭টি, রাজশাহীতে ৩০৫টি, রংপুরে ৯৯টি, বরিশালে ৮৬টি এবং সিলেটে ৬৪টিসহ মোট ২১৮৪টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ ধরনের অভিযান এটাই প্রথম নয়। অতীতেও বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে। ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি, বন্ধ হয়নি প্রতারিত হওয়ার ঘটনা। তবে স্বীকার করতে হবে, এবারের অভিযান একেবারে নিষ্ফল নয়। সময়ে সময়ে অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান কিছুটা কাজ দেয়। কিন্তু টেকসই স্বাস্থ্য খাতের জন্য তা যথেষ্ট নয়। তারা বলছেন, দরকার নিয়মিত কঠোর নজরদারি আর তদারকি।
অভিযানের ফলাফল জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘আনকম্প্রোমাইজ অভিযান ছিল। বার্তা ছিল স্পষ্ট। অভিযানের পর অনেকেই লাইসেন্স করছে। রেভিনিউ পাওয়া শুরু করেছে সরকার।’ তিনি বলেন, ‘এটা স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত কাজ।’ অতিরিক্ত মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘তাদের এই আপসহীন অভিযানে, সরকারের যেমন রাজস্ব বেড়েছে, তেমন অনেকেই নড়েচড়ে বসেছেন। লাইসেন্সও করছেন অনেকেই। কিন্তু জানতে পেরেছি সেই দুষ্টু লোকরা অভিযানের পরও ঠিক হয়নি।’
রাজধানী মিরপুরের বাউনিয়াবাঁধ এলাকা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, টানা দুই দফা অভিযানে ঢাকা মহানগরে লাইসেন্সবিহীন যে ৩৩টি প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাডব্যাংক বন্ধ করা হয়েছিল, তার একটি রয়েছে এখানে। নাম ‘হলি হোমস ক্লিনিক’। প্রতিষ্ঠানটিকে গত ৩১ আগস্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে কোথাও কোনো সাইনবোর্ড দেখা গেল না।
স্থানীয়দের সহযোগিতায় পাওয়া গেল সেই অনুমোদনহীন হলি হোমস ক্লিনিক। কিন্তু বাইরে থেকে চারতলা ভবন দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, এখানে কোনো হাসপাতাল রয়েছে। মাত্র দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দিনের পর দিন চলে আসছে স্বাস্থ্যসেবার নামে প্রতারণা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক অভিযানে গত তিন সপ্তাহ আগে বন্ধ করে দেয়া হয় আলোচিত ক্লিনিকটি। তবে সপ্তাহ না পেরোতেই ক্লিনিকটিতে গিয়ে দেখা যায়, অনুমোদন ছাড়াই সেটি চলছে আগের মতো। ক্লিনিকের ভেতরে চলছে রান্নাবান্না, রোগীর বিছানায় শুয়ে আছেন কয়েক লোক। যদিও তাদের কেউই রোগী নন। পাশের ফ্ল্যাটটিতে গিয়ে দেখা মেলে কয়েক রোগীর। এক রোগীর মা নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে এসেছি। সিজার কেস।’ তিনি জানান, হাসপাতালটি যে বন্ধ— তা জানলে তিনি মেয়েকে নিয়ে এ ক্লিনিকে আসতেন না।’
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ‘ক্লিনিকটির রান্নাঘরের সঙ্গে অপারেশন থিয়েটার। নোংরা, অপরিচ্ছন্ন-পুরোনো মেশিন। সেই কক্ষটিতেই চলে অপারেশন।
অনুমোদন ছাড়া হাসপাতালের কার্যক্রম চালানো সম্পর্কে জানতে চাইলে হলি হোমস ক্লিনিকের ম্যানেজার কামাল মোল্লা বলেন, ‘ভাই কী করতে হবে বলেন? আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
রাজধানীর আজিমপুরের নিউ সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টার। লাইসেন্স না থাকায়, স্বাস্থ্য অধিদফতর গত ৬ সেপ্টেম্বর এটি বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সিকান্দার বলেন, ‘আমরা বন্ধ রেখেছি। কোনো কার্যক্রম চলে না।’ কাগজপত্র ছাড়া এত দিন কীভাবে চালালেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, কাগজপত্র প্রস্তুত করছি।’ সরেজমিনে দেখা গেল ক্লিনিকটির কার্যক্রম দিব্যি চলছে আগের মতো।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযান থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, নিবন্ধন ছাড়াই এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি চলছে ৩ বছরের বেশি সময়। এমনকি বন্ধ করে দেয়ার পরও সেটি চালিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় আল শাফি হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকা বলছে, ‘অনুমোদন না থাকায় এই হাসপাতালটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে দেখা গেছে, হাসপাতালটি খোলা। নাম-পরিচয় গোপন করে ম্যানেজার মিজানুর রহমানকে বলা হয় রোগী ভর্তি করতে চাই— হাসপাতাল বন্ধ কিনা?
জবাবে তিনি বলেন, ‘বন্ধ কেন হবে? রোগী ছিল তো, কাল চলে গেছে। এখনও আছে। ম্যাডাম মাঝে মধ্যে দেখেন।’ বন্ধ প্রতিষ্ঠান চলে কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে তো কেউ আসেনি, বন্ধও করেনি।’ হাসপাতাল মালিক ডা. ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এটা বন্ধ করেনি। দু’দিন আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডা. শাহরিয়ার ও ডাবিলাল এসেছিলেন, তারা চালু করতে বলে গেছেন।’
মিরপুর ১১ নম্বর সেকশন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বন্ধের তালিকা অনুযায়ী এখানে ‘শেখ সেবা’ নামের একটি মেডিকেল হল থাকার কথা। কিন্তু কোথাও কোনো সাইনবোর্ড নেই, স্থানীয়রাও ঠিকমতো বলতে পারেন না। এবার ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখা গেল— ‘শেখ সেবা’র জায়গায় এখন মিরপুর মানবকল্যাণ সংস্থা। এই নামে কোনো মেডিকেল হল এখানে নেই। তারা অনেক আগে এখান থেকে চলে গেছে। সেখানে থাকা হ্যাপী আক্তার নামের নারীর দাবি, বন্ধ করে দেয়ার আগেই তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ও কাজের ধরন বদলে গেছে।
জানতে চাওয়া হয়— এক সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর তাহলে কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করল? এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি। সংস্থাটির ঘরগুলোতে দেখা গেল রোগী দেখা ও রোগী রাখার সরঞ্জাম। বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করতেই হ্যাপী আকতার বলেন, ‘এটি একটি এনজিও, আমরা সেবামূলক কাজ করি।’
ডেলিভারি বা অন্য কাজগুলো করতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের অনুমতি আছে, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় আমাদের অনুমতি দিয়েছে।’ সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের গঠনতন্ত্র দেখেন। কী কী করতে পারি। আমরা ধাত্রী সেবা দিতে পারি।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহা-পরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘এটা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাজ, এটা আমাদেরই দায়িত্ব। কেউ মুদি দোকানের মতো দোকান খুললে হবে না। প্রয়োজনে আবার অভিযান চালানো হবে। যদিও আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।’
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ