জাতীয় মহিলা সংস্থা পরিচালিত নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পটির অবস্থান আগে শীর্ষে থাকলেও সম্প্রতি প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব নুরুন নাহার হেনার অনিয়ম ও দুর্নীতির কবলে পড়ে প্রকল্পটি এখন মৃতপ্রায়। মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দেয়ার পরেও কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। উল্টো পদোন্নতি দিয়ে চলতি মাসের ৭ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সাকিউন নাহার বেগম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমি এখন এই প্রকল্পতে নেই। তবে আমি থাকাবস্থায় উনার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে একটি অভিযোগ পড়েছিল শুনেছিলাম।’ কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘না, আমি থাকা অবস্থায় কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়নি।’
অভিযোগ থেকে প্রকল্প ব্যয় সম্পর্কে জানা গেছে, এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়নবিষয়ক একটি প্রকল্প যা ৮৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০১৬ হতে জুন ২০২০ মেয়াদে বাস্তবায়ন। ১ম সংশোধন ৮৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জুন, ২০২১ মেয়াদে বাস্তবায়ন এবং দ্বিতীয় সংশোধন ৯৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
অভিযোগ সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়নবিষয়ক একটি প্রকল্প ছিল। সম্প্রতি দুদকসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে দেয়া অভিযোগে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। নুরুন নাহার হেনার দুর্নীতির বিষয়ে গত ২৬ অক্টোবর নয়া শতাব্দীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের আগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে অতিরিক্ত সচিব নুরুন নাহার হেনার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কথা বলার কয়েক মিনিট পরে প্রতিবেদকের ফোনে একটি জিপি নম্বর থেকে কল আসে। হুমকি দিয়ে জানতে চাওয়া হয় প্রতিবেদকের নানা পরিচয়। এরপরে রাতে ফোন কলের মাধ্যমে নয়া শতাব্দীর অপর এক প্রতিবেদককে অকথ্য ভাষায় হুমকি-ধমকি দেয়া হয়। সেই মোবাইল নাম্বারের মালিকের সন্ধানে চলে নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধান।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। হুমকি দেয়া সেই মোবাইল নাম্বারের মালিক জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মুকুল হোসেন। পেশা- সরকারি চাকরিজীবী। পিতা- মো. সবির উদ্দীন মোল্লা, মাতা- মোছা. মেহেরুন নেছা, জেলা রাজবাড়ী। তিনি একটি বাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরি করতেন। তবে এখন সে চাকরিচ্যুত। এরপরও তিনি নিজেকে কখনও মেজর আবার কখনও পুলিশ সুপার পরিচয় দেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। নয়া শতাব্দীর হাতে আসে একটি গোপন নথি। সেখানে দেখা যায়, মুকুল হোসেনের নামে মাদক, প্রতারণা, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে তিনটি মামলা রয়েছে। ২০১৯ সালে ১০ মে ডিএমপির বিমানবন্দর থানায় একটি মাদক মামলা রয়েছে। যার মামলা নং ৯/১৮৬। জিআর নং, ১৮৬/১৯। সে এই মামলায় এজাহারনামীয় আসামি। ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর রমনা মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় তিনি এজাহারনামীয় আসামি। যার মামলা নং ২০/২০৩। ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রমনা মডেল থানায় একটি প্রতারণা মামলার আসামি এই মুকুল। যার মামলা নং ২১/৫৫। এই মামলায় ও তিনি এজাহারনামীয় আসামি।
দুর্নীতির টাকায় সম্পদের পাহাড় : অভিযোগ রয়েছে সরকারি প্রকল্পের টাকায় হেনা ঢাকার মেরাদিয়াতে জমি ক্রয়, ৩০ সার্কিট হাউস, ইস্টার্ন সার্কিট হাউস রোডে একটি ফ্ল্যাট থাকার পরেও ওই বাড়ির বিপরীত পার্শ্বে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭, সার্কিট হাউস, ফ্ল্যাট নং- সি/৬, ইস্টার্ন সার্কিট হাউস রোডে নতুন একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। এছাড়াও নামে বেনামে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্প্রতি সরকারের কয়েকটি দফতরে পড়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ২০২০-এর আগে জাতীয় মহিলা সংস্থা পরিচালিত ৪টি প্রকল্পের মধ্যে নগরভিত্তিক ফেস-২, প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের অবস্থান শীর্ষে থাকলেও প্রকল্প পরিচালকের অনিয়ম-দুর্নীতির কবলে পড়ে বর্তমানে এটি একটি মৃত প্রকল্পে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
প্রকল্প পরিচালকের দুর্নীতির কয়েকটি খাত : টিএ/ডিএ এবং ভ্রমণ ব্যয়— কোথাও কোনো রকমের ভ্রমণ না করেও প্রতিমাসে কাল্পনিক ভ্রমণ বিল দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। একই দিনে একাধিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ভ্রমণ করলেও বিল করা হয় ভিন্ন ভিন্ন দিনের। সরকারি গাড়িতে গেলেও বিল করা হয়েছে বিমান ও ভাড়া গাড়ির।
যন্ত্রপাতি/মেরামত ও সংরক্ষণ— প্রকল্প পরিচালকের কক্ষে টেলিভিশন সেটিং, তোয়ালে, প্রধান কার্যালয়ের বেসিন মেরামত দেখিয়ে অর্থ উত্তোলন করা হলেও বাস্তবে তার দেখা মেলেনি। সম্প্রতি কাগজে-কলমে ক্রয় করা একটি এয়ার কন্ডিশনার, মোবাইল ফোন, চেয়ার-টেবিল, আলমিরা ক্রয়ের নামে কয়েক লাখ টাকা লুট করেছেন এই প্রকল্প পরিচালক।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অভিযোগ আমলে না নিয়ে কোনো ধরনের তদন্ত কমিটি গঠন না করে তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রকল্প পরিচালক থেকে চলতি মাসের ৭ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে এত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। সেই তাকেই পদোন্নতি দেয়া মানে সরকারের আরও একটি প্রকল্পের ক্ষতিসাধন ছাড়া কিছুই না।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার। সেই আলোকে শহরভিত্তিক গরিব, দুস্থ ও বিত্তহীন নারীদের যথোপযুক্ত দক্ষতা, উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করে উৎপাদনমুখী, কর্মক্ষম এবং আত্মনির্ভর হিসেবে গড়ে তুলতে হাতে নেন এই প্রকল্প। কিন্তু সরকারের সেই উদ্যোগে ভাটা পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক কর্মী বলেন, সরকারের সুন্দর একটি প্রকল্প লুটেপুটে খেয়ে এখন অন্য প্রকল্পে গেছেন। এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী একটি চক্র। টাকা ছাড়া কোনো ফাইলেই স্বাক্ষর করতেন না হেনা। সবধরনের অনুষ্ঠান ও ভ্রমণের নামে ভুয়া ভাউচার বানিয়ে হাতিয়ে নিতেন টাকা।
প্রকল্প পরিচালক নুরুন নাহার হেনার দুর্নীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুদকসহ বিভিন্ন দফতরে দেয়া অভিযোগপত্রে তার বিরুদ্ধে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় পূর্ব প্রকল্পের ৭৮ জনকে টাকা ছাড়া নিয়োগে অস্বীকৃতি জানালে ৭৮ জন ও প্রকল্পে নিয়োগ না নেয়া ৬ জন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার মাধ্যমে প্রকল্পে নিয়োগ নিশ্চিত করে। (২৪৫-৭৮)=১৬৭ জনের মধ্যে ৩৪ জনই প্রকল্পের পরিচালক নুরুন নাহার হেনার আত্মীয়-স্বজন। যারা ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে প্রকল্পে নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যাদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে চাকরি দিয়েছেন বলে জানানো হয়।
টাকা চুরির নাটক : নিজে টাকা সরিয়ে সহকর্মীদের ওপর দায় চাপাতে কোরআন শরিফ হাতে নিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ করানোর অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের শেষ পর্যায়ে আত্মসাৎযোগ্য বিভিন্ন খাত হতে ১৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে প্রধান কার্যালয়ের একটি আলমিরাতে রাখা হয়। ওই আলমিরার চাবি স্বয়ং প্রকল্প পরিচালকের ড্রয়ারে এবং ড্রয়ারের চাবি তার কাছে থাকার পরেও জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আলমিরা থেকে টাকা চুরির নাটক করেন।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসের একজন নয়া শতাব্দীকে জানান, ‘প্রথমে ১০০ টাকার নতুন বান্ডিল হারানোর গল্প উপস্থাপন করা হয়। পরের সপ্তাহে ৫০০ টাকার বান্ডিল এবং তার পরের সপ্তাহে হাজার টাকার বান্ডিলসহ সব টাকা চুরির গল্প শোনানো হয় এবং প্রধান কার্যালয়ে প্রকল্প পরিচালকের কক্ষে থাকা আলমিরা হতে টাকা এই প্রকল্পের অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চাপানো হয়।
তারা আরও বলেন, এক পর্যায়ে প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন আপত্তি ও আলমিরা বিশেষজ্ঞ দেখানোর অনুরোধ তোলা হলেও তা কর্ণপাত করেননি প্রকল্প পরিচালক। এছাড়াও উপকরণ, সিএনজি ও জ্বালানি, টিওটি প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক মেলা এবং স্টাডি ট্যুর, অভ্যন্তরীণ মেলা ও ডকুমেন্ট, জাতীয় দিবস বা উৎসবের নামে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন খাত থেকে ভুয়া বিল দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা লুটপাট করার অভিযোগ তুলেছেন সেই অভিযোগপত্রে।
সম্প্রতি, এই পদোন্নতি ও আগের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়ে তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে এর আগের প্রতিবেদনে এমন বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব নুরুন নাহার হেনার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে অকপটে স্বীকার করেন এবং তিনি প্রতিবেদন না করার জন্য বিভিন্নভাবে অনুরোধ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়বকে মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ