লাশের ডাম্পিং জোনে পরিণত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী। সর্বশেষ ১০ মাসে রাজধানীর উপকণ্ঠ ঘেঁষা বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী থেকে ৯০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে অনেক লাশ পচে-গলে যাওয়ায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে বিলম্ব হচ্ছে। তারা খুন হয়েছেন নাকি দুর্ঘটনার শিকার তা নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্ত তদারক কর্মকর্তারা।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই খুনের শিকার হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে নদীসংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি নৌ-পুলিশকে আরও সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, গত ২২ মাসে দেশের বিভিন্ন নদী থেকে ৬৭৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৭৭টি। এছাড়া অজ্ঞাত হিসাবে দাফন করা হয়েছে ১৮০ জনকে। অজ্ঞাতদের মধ্যে অনেকেই খুনের শিকার হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নদীতে নৌ-পুলিশের পাশাপাশি সড়কে ঢাকা জেলা পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। অপরাধীরা যেন সহজেই পার পেতে না পারে এ কারণে নদীসংলগ্ন এলাকায় টহল জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে কেরানীগঞ্জে নদীসংলগ্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যেগ নেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর বেশ কিছু নির্জন স্থানকে অপরাধীরা লাশ ফেলার নিরাপদ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করছে। ওইসব এলাকায় পুলিশের তৎপরতা কম থাকায় এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারণা। পাশাপাশি নৌ-পুলিশকে আরও আধুনিকায়ন করারও তাগিদ দিয়েছেন তারা।
একই সঙ্গে নৌপথে টহল জোরদারের পরামর্শও দিয়েছেন তারা। যদিও নৌ-পুলিশের দাবি তারা সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করছেন। বেশির ভাগ খুনের ঘটনা ঘটছে স্থলে। পরে তা ফেলা হচ্ছে নদীতে। এ কারণে তদন্তে বেগ পেতে হচ্ছে।
নৌ-পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ২২ মাসে বিভিন্ন নদী থেকে ৬৭৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার ৭৭ জন। মোট লাশের মধ্যে ১৮০ জন শনাক্ত হয়নি। এর মধ্যেও খুনের ঘটনা থাকতে পারে।
অনেদের মরদেহ থেকে মাংস ও হাড়ও আলাদা হয়ে যাওয়ায় ময়নাতদন্তে তেমন কোনো ফলাফল নির্ধারণ সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ধারণা করা হচ্ছে, স্থলে পুলিশের নানামুখী তৎপরতা ও বিভিন্ন পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা থাকার কারণে খুনের পর এখন নদীতে লাশ ফেলার নিরাপদ স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছে অপরাধীরা।জানা গেছে, ২০২১ সালে নৌ পুলিশের আওতাধীন বিভিন্ন নদী থেকে ৩৫৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২৩ জনের মৃত্যুর বিষয়ে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে। হত্যা মামলা হয়েছে ৩৬টি। ১৯৮ জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তারা নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত হন।
এছাড়া ৮৮টি লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ফলে এসব মরদেহ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এই ৮৮ জন খুনের শিকার নাকি দুর্ঘটনার নিহত হয়েছেন তা অন্ধকারেই রয়ে গেছে। এ বিষয়ে পুলিশের তৎপরতাও তেমন চোখে পড়েনি বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসি দাবি করেছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন নদী থেকে ৩১৮টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪১ জন। পরিচয় না মেলায় ৯২ জনের মরদেহ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা এখনও অজানা। আদৌ বের হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা ও বালু নদ থেকে ৯০ মরদেহ উদ্ধার করেছে নৌপুলিশ। তবে উদ্ধার করা লাশের মধ্যে নৌ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরাও আছেন। তবে দুর্ঘটনার সংখ্যা খুবই কম বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে।
ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্ট না পাওয়ায় এদের মধ্যে খুনের পরিসংখ্যান এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে হত্যার সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। অক্টোবরের শুরুতে তুরাগ ও আমিনবাজার থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই দুই যুবককে হত্যা করা হয়েছে বলে সুরতহাল রিপোর্টে ওঠে আসে। তবে তাদের পরিচয় এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অজ্ঞাত মরদেহের পরিচয় শনাক্তে এখন ফিঙ্গার প্রিন্টকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ মরদেহ পচে-গলে যাওয়ায় অনেকের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া সম্ভব হয়নি। চেহারা দেখেও পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বেওয়ারিশ হিসেবে কিছু কিছু মরদেহ দাফন করা হচ্ছে। ফলে অজানাই থেকে যাচ্ছে মৃত্যুর কারণ। হত্যা, দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা তাও পরিষ্কার করা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, চলতি মাসের ৪ তারিখে নিখোঁজ বুয়েটের ছাত্র ফারদিন হত্যার পর তার ৭ তারিখ তার মরদেহ পাওয়া যায় শীতলক্ষায়। এ ঘটনার একদিন পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুরন্ত বিপ্লব এবং আরও একটি অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বুড়িগঙ্গায় এক লাশ ভাসতে দেখে থানায় খবর দেয় এলাকাবাসী। পরে পাগলা নৌ ফাঁড়ি পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। অজ্ঞাত ব্যক্তির বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। তার কান, চোখ ও কপালে কাটা চিহ্ন ছিল। পরিচয় না মেলায় নৌ পুলিশ লাশটি অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করে।
এ ঘটনার পর পাগলা নৌ ফাঁড়ি পুলিশ বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ পানগাঁও থেকে জাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুরন্ত বিপ্লবের লাশ উদ্ধার করে। প্রথমে লাশটি অজ্ঞাত ছিল। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লবের মাথা ও বুকে আঘাতের আলামত দেখে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ধারণা করেছেন, এটিও হত্যাকাণ্ড। এমন পরিস্থিতিতে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদী কী লাশ ফেলার ডাম্পিং জোনে পরিণত হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নৌ-পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ, রাজধানীর সদরঘাট, বরিসুর, বছিলা, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও টঙ্গী পর্যন্ত নদীপথ এবং ডেমরা ও রাজাখালী ছাড়াও নরসিংদীর কিছু এলাকা ঢাকা অঞ্চলের আওতাধীন। এসব এলাকার নদীর পাড় ঘেঁষে অনেক বসতি রয়েছে। আবার অনেক এলাকায় কোনো বসতি নেই। সেসব এলাকায় দিনের বেলায় লোকজনের উপস্থিতি থাকলেও রাতের বেলায় একেবারেই নীরব থাকে।
এ কারণে স্থানীয়দের ধারণা হত্যার করে এসব এলাকায় দিয়ে নদীতে মরদেহ ফেলা দেয়া হচ্ছে। এরপর তা ভাসতে ভাসতে বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে। এ কারণে খুনের মোটিভ ও স্থান নিয়ে ধোঁয়াশায় থেকে যাচ্ছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
গত ১৬ মে সোয়ারীঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে এক যুবকের লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন। তাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে নৌ পুলিশ লাশ উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। ৭ মে বছিলা এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে নাসরিন আক্তার নামে ২৬ বছর বয়সি এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। তিনি রাজধানীর মিরপুর থেকে গাবতলীর বর্ধনবাড়ী যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছিলেন। এর দুই দিন পর নদীতে পাওয়া যায় তার মরদেহ।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ