ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

তদন্তে নতুন মোড়

প্রকাশনার সময়: ১৮ নভেম্বর ২০২২, ১১:২৬

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যায় জড়িত খুনিরা চিহ্নিত হয়েছে এবং তার সবশেষ অবস্থান চনপাড়ায় দেখা গেছে বলে দাবি করছে র‍্যাব। অন্যদিকে, ঘটনার দিন রাত সোয়া ২টার দিকে ফারদিনকে ৩ থেকে ৪ যুবক যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় উঠিয়ে তারাবোর দিকে নিয়ে যায় বলে দাবি করছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির দাবি, মাত্র ১৫ মিনিট সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই কারও পক্ষে চনপাড়ায় যাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে মামলার রহস্য উদঘাটনে ওই লেগুনার চালক ও আরোহীদের খোঁজা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, চনপাড়ায় নয়, ফারদিনকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনার দিন রাত সোয়া ২টার দিকে ফারদিনকে যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। সাদা পোশাক পরা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে লেগুনার ওঠে সে। এরপর লেগুনা তারাবো বিশ্বরোডের দিকে চলে যায়। সে সময় লেগুনায় আরও চারজন ব্যক্তি ছিলেন। সাদা পোশাক পরা ব্যক্তি, লেগুনার চালক ও লেগুনায় আগে থেকে থাকা চারজনকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

তিনি আরও বলেন, সময় ও দূরত্ব বিবেচনা অনুযায়ী ওই রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে কোনোভাবেই ফারদিনের চনপাড়ায় যাওয়া সম্ভব না। কারণ ওখান থেকে চনপাড়ার দিকে রওনা দিলেও আড়াইটার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই খুন চনপাড়ায় নয়, অন্য কোথাও হতে পারে বলে ধারণা করছে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে ডিবি কাজ করছে বলেও জানান তিনি। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই এ ঘটনার রহস্যভেদ করা সম্ভব হবে।

এদিকে, চনপাড়া বস্তির রায়হানের নেতৃত্বে ৭ থেকে ৮ জন এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলে দাবি করেছে র‍্যাব। তবে কী কারণে তাকে হত্যা করেছে এবং কোথায় ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়টি এখন পরিষ্কার নয় তারা। এছাড়া মাদক সেবনের সঙ্গে ফারদিনের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা সে বিষয়টি নির্ভর করছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও ভিসেরা রিপোর্টের ওপর। যদিও ঘটনার সঙ্গে জড়িত রায়হানসহ বেশ কয়েকজনকে এরই মধ্যে র‍্যাবের হেফাজতে নেয়া হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করলেও র‍্যাবের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়নি।

জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যেম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন নয়া শতাব্দীকে বলেন, প্রাথমিক ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা তথ্যে ফারদিন হত্যাকাণ্ডে চনপাড়া বস্তির মাদক ব্যবসায়ী রায়হানের নেতৃত্বে ঘটেছিল বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় জড়িত ৭ থেকে ৮ জনের সন্ধানে মাঠে নেমেছে র‍্যাব। তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হলেই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।

যদিও র‍্যাবের এই দাবির সঙ্গে একমত নয় ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রায়হান গ্যাংয়ের সঙ্গে আমার ছেলের কী নিয়ে বিরোধ থাকবে? বুঝলাম সে (রায়হান) একটা খারাপ মানুষ। কিন্তু আমাকে বোঝান, আমার ছেলেটাই কেন তার টার্গেটে পড়বে? সে কেন ওখানে (চনপাড়ায়) যাবে? কীভাবে সম্ভব সেটা! কোন তথ্যের ভিত্তিতে দেখাবেন সেখানে আমার ছেলেটা মুভ করেছে? সে যদি সেখানে না থেকে থাকে তাহলে এসব বলার অর্থ কী? জানা গেছে, গত ৪ নভেম্বর নিখোঁজ হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নুর পরশ। ৭ নভেম্বর শীতলক্ষ্যা নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় তার বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা বাদী হয়ে ফারদিনের বান্ধবী বুশরাকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় বুশরাকে গ্রেফতারের পর ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। রিমান্ডের শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনার তার কাছ থেকে খুনের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র মতে, এখনো হত্যার মোটিভ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। রিমান্ডে থাকা ফারদিনের বান্ধবীর কাছ থেকে মেলেনি উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য। তাই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ এখন নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে। বিভিন্ন স্থানে চলছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযান। নতুন কাউকে গ্রেফতার করা গেলে তদন্তে গতি আসবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, লেগুনায় ওঠার পর হয়তো ফারদিন অপহরণকারীদের হাতে পড়েছিল। তারা যখন বুঝতে পারে ফারদিন বুয়েটের ছাত্র এবং বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা হতে পারে তখন তারা তাকে খুন করে নদীতে ফেলে দেয়। পাশাপাশি ঘটনার পেছনে মুক্তমনা বিরোধিতাকারীদের হাত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না সংস্থাটি। সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা বলেন, ডিবি আমাকে ডেকেছে, ছেলের পড়াশোনা, বয়স, মাদকে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চেয়েছে। সে মুক্তমনা ছিল কি না, যেসব জায়গায় গিয়েছে সেসব জায়গায় অন্য কোনো বন্ধু রয়েছে কি না, এসব বিষয় জানতে চেয়েছে। কিন্তু এখন ঠিক বুঝতে পারছি না-সে আসলে কেন গিয়েছিল যাত্রাবাড়ীতে।’ মাদকের সঙ্গে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাদকে জড়ানোর বিষয়ে ডিবি কিছুই বলেনি আমাকে। মাদকের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায়নি, সেটা ডিবি পুলিশ ক্লিয়ার করেছে। আমিও এর আগে বলেছি। আমার ছেলে কখনও ধূমপান করত না। এমনকি ধোঁয়াও সহ্য করতে পারত না।’ বিদেশ যাওয়া নিয়ে কোনো অবসাদে ভুগছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, সে রকম কিছু নয়। আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই গল্প উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছে। বিদেশ যাওয়া হলো না বলে ভেঙে পড়ার মতো ছেলে সে নয়। ওর চরিত্রের মধ্যে সেরকম কিছু নেই। হত্যার বিষয়ে ডিবি পুলিশ ও র‍্যাব জোর দিয়ে তদন্ত করছে। থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার পর। যেহেতু সাসপেক্ট করা হচ্ছে। পরিকল্পিত কি না সেটা বের করতে হলে সময় লাগতে পারে। সব বিষয়ে আমরা তো অনুমান করতে পারি না।’ যদিও র‍্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রায়হান গ্যাং ফারদিন হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছে। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রায়হানসহ বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। রায়হানকে আইনের আওতায় আনতে পারলে খুনের মোটিভ উন্মোচন করা সম্ভব হবে বলে দাবি করা হলেও ফারদিন চনপাড়ায় কেন গিয়েছিল সে কারণটা এখনো বের করতে পারেনি র‍্যাব।

র‍্যাবের দাবি, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি তারা এই মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা ঘটনার পর ফারদিনের শেষ লোকেশন চনপাড়ায় ছিল বলে দেখতে পান। এরপর তারা ওই এলাকায় গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। এ পর্যায়ে তারা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ওই রাতে একটি সন্দেহভাজন প্রাইভেটকার গভীর রাতে আসা-যাওয়া করার দৃশ্য দেখতে পান। একপর্যায়ে তারা ওই প্রাইভেটকারে ফারদিনের মরাদেহ সরানো হয়েছে বলে ধারণা করেন। একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে কয়েকজন যুবকের সন্দেহভাজন ঘোরাফেরা এবং একটি প্রাইভেটকার দ্রুতগতিতে চলে যাওয়ার ফুটেজ দেখা গেলেও সেখানে ফারদিনের চেহারা দেখা যায়নি। ওই ঘটনার পর র‍্যাবের বন্দুকযুদ্ধে সিটি শাহিন নামের মাদক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নেয়া হয় আরও কয়েকজনকে। তারা রায়হান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে র‍্যাবের কাছে স্বীকার করেন বলে একটি সূত্র দাবি করে। তবে র‍্যাবের পক্ষ থেকে এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে জানান হয়েছে।

নয়াশতাব্দী/জেডআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ