ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মিলেমিশে একাকার পার্কিং-বাজার

প্রকাশনার সময়: ১৬ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৩৬

ফুটপাতে হাঁটাই দায়। মূল রাস্তার বেশির ভাগ অংশ অবৈধ দোকানপাট, ভ্যান-রিকশা আর গাড়ির দখলে। কাওরানবাজারে প্রবেশের রাস্তাটিতে ঢুকলেই পড়তে হয় দুর্ভোগে। দু’শো বছরের পুরনো এ বাজারে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করেন হাজারো মানুষ। সরকারি-বেসরকারি অনেক অফিস রয়েছে রাস্তাটির দুপাশে। তবুও নেই দখলমুক্ত করার উদ্যোগ।

একই অবস্থা রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার প্রধান সড়কের রেলগেট থেকে লেকসিটি পর্যন্ত। এ সড়কটির দুই পাশেই দোকানিরা তাদের মালামাল ফুটপাতে রেখে প্রদর্শনী করছেন। হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকরা দোকানের পরোটা, শিঙ্গাড়া, সমুচা ও জিলাপিসহ বিভিন্ন খাবার প্রস্তুতের চুলা ফুটপাতে রেখেই কাজ করছেন।প্রতিদিনই রাস্তা দখল করে চলছে এমন বেচাকেনার মহোৎসব। মাঝে-মধ্যে করা হয় গাড়ি পার্কিং। ফুটপাত, গাড়ি পার্কিং, অবৈধ দোকানপাট আর বাজার মিলেমিশে একাকার।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে রাখা আছে সারি সারি পণ্যের বস্তা, হচ্ছে রকমারি সব ফলের বেচাকেনা। সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক শুনে যে কারও ভুল হতেই পারে, এটি হয়তো কোনো পেঁয়াজ কিংবা ফলের আড়ত। অথচ এটি আসলে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি প্রধান সড়কের একটি সাধারণ দৃশ্য।

কাওরানবাজার এলাকার পথচারী কামরুল ইসলাম বলেন, এদিকে পার্কিং, ওদিকে দোকানপাট, আরেকদিকে ভ্যান, হাঁটার জায়গা নেই। যে যার মতো করে গাড়ি উল্টা-পাল্টা করে ঢোকায়, রিকশাও যাচ্ছেতাইভাবে চলছে, হাঁটার জায়গা নেই।

সুধাংশু কর বলেন, অনেক সময় এমন অবস্থা শুরু হয় যে, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। মুরগির দোকানসহ বিভিন্ন দোকানের বর্জ্য, এগুলো বর্জ্য যে, আমাদের জন্য কী সমস্যা! কাওরানবাজারের বিক্রেতারা বলছেন, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনকে টাকা দিয়েই ফুটপাত ও সড়কে ব্যবসা করছেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিক্রেতা বলেন, পুলিশে টাকা নেয়, মেথরও টাকা নেয়। এখানে তো সিটি করপোরেশন থেকে ভাড়া নেয়া হয়।

আরেক বিক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারকে টাকা-পয়সা দিয়েই আমরা বসি, আমরা তো ফাউ বসিনা।’

সড়ক এবং দুই পাশের ফুটপাতের বেশির ভাগ জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে দোকান আর রয়েছে গাড়ি পার্কিং। এতে প্রতিদিন সড়কে জ্যাম সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। একই সঙ্গে পথচারীরা পার হতে গিয়ে পড়ছে বিড়ম্বনায়। এই চিত্র রাজধানীর প্রায় প্রতিটি প্রধান সড়কের। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে বারবার জানালেও মুক্তি মেলেনি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বসানো বাজারের দোকান থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। সড়ক ও ফুটপাত দখল করে মাছ, মাংস, সবজি, ফল, ফুসকা, ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান, মসলাজাতীয় পণ্যের দোকান বসানোয় পথচারীরা চলাচল করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছে।

ইজারা নেয়া বাজারের মতো টোকেন বানিয়ে দোকানপ্রতি নৈশপ্রহরীর জন্য প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে ১০০ টাকা। দোকানভেদে ভাড়া বাবদ প্রতিদিন আদায় করা হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। যাদের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে তাদের কাছ থেকে একসঙ্গে মাস শেষেও এই ভাড়া আদায় করা হয়। বিভিন্ন কমিটির নামে করা হচ্ছে এই অবৈধ বাণিজ্য। যার সভাপতি স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রভাবশালী কেউ না কেউ।

দোকানিরা জানান, সড়কে বাজার বসানোর বিনিময়ে প্রতিদিন বিভিন্নভাবে আদায় করা হয় লাখ টাকার বেশি। আবার সিটি করপোরেশনের অনুমোদনে যাদের বৈধ দোকান রয়েছে তাদের কেউ কেউ দোকানের সামনে ফুটপাতে বসানো দোকান থেকে নিজেরাই প্রতিদিন ভাড়ার নামে অর্থ আদায় করছে। একইভাবে ওই সড়কে কিছু বাড়ির মালিকও একই কাজ করছেন।

রাজধানীর মাটিকাটা বাজারের সবজি বিক্রেতা রহমত আলী বলেন, ‘এটা সরকার অনুমোদিত বাজার নয়। সড়কে বসতে বসতে বাজার হয়ে গেছে। এখানে ব্যবসা করতে হলে কথিত বাজার কমিটিকে নির্দিষ্ট চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা যারা নেন তাদের মধ্যে স্থানীয়সহ বিভিন্ন দলের লোকজনও আছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই বাজার দেখভালের জন্য রয়েছেন ছয়জন নৈশপ্রহরী। তাদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। আর প্রতিদিন চাঁদা তুলে যার কাছে জমা দেয়া হয় তাকে মাসে বেতন দেয়া হয় ১৫ হাজার টাকা। তবে প্রতি মাসে ওই বাজার থেকে ভাড়া ও বেতনের নামে তুলে নেয়া হয় অন্তত ৩০ লাখ টাকা।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন ফল বিক্রেতা বলেন, ‘বাড়ির সামনের সড়কে বসি বলে চার বছর ধরে বাড়িওয়ালাকে ভাড়া দিচ্ছি। আবার বাজার কমিটিকেও দিতে হয়। না হলে তারা উঠিয়ে দেবে। সব মিলিয়ে আমার এই ছোট্ট দোকান থেকে মাসে ভাড়া ও চাঁদা বাবদ আট হাজার টাকার বেশি দিতে হচ্ছে।’

জানতে চাইলে মাটিকাটা এলাকার বাসিন্দা সেকান্দর আলী ও আবদুর রহমান জানান, ‘ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বাজার বসানোয় এলাকাবাসীর চলাচল করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু-বৃদ্ধ, নারী এবং শিক্ষার্থীদের বাজারের ভিড় ঠেলে রাস্তা পার হতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। তারা চান বাজার উচ্ছেদ করে সড়কটি দখলমুক্ত হোক।’

বাজারটি উচ্ছেদে গত বছরের ২৬ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচবার এলাকাবাসীর পক্ষে অন্তত দুজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, মিরপুর-২-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগপত্র দিয়েছেন; কিন্তু এখনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, মাটিকাটা এলাকার প্রধান সড়কে ও ফুটপাতে এলাকার চাঁদাবাজ কসমেটিক মিজান ও মোল্লা খোকন গং ভুয়া ব্যবসায়ী সমিতির নামে দোকান বসিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করছে।

একজন অভিযোগকারী বলেন, ‘আমরা চাই এই অবৈধ বাজার এবং চাঁদাবাজি বন্ধ হোক। এ পরিস্থিতির কারণে এলাকার মানুষদের প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাতে হবে, এটা দুঃখজনক। আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’ দোকান থেকে টাকা আদায়কারী আকরাম বলেন, ‘গত দুই মাস আগে আমি আদায় করেছি। তবে এখন অন্যজন আদায় করছে। আমরা এই টাকা আদায় করি দারোয়ান ও পরিচ্ছন্নতাকারীদের জন্য। আর কিছু টাকা জমলে সেটা মানবিক কাজে ব্যয় করা হয়।’ মিজানুর রহমান মিজান (কসমেটিক মিজান) চাঁদা আদায়ের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘চাঁদা আদায়ের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সমিতির সঙ্গে আগে জড়িত ছিলাম, এখন নেই। বর্তমানের এটা মালিক সমিতি বলতে পারবে।’

কথিত ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান হোসেন খোকন বলেন, ‘দোকানদারদের কাছ থেকে রাতে পাহারা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ কেউ কিছু টাকা নিলে নিতে পারে। এ বিষয়ে আমি সঠিক জানি না। এটি অনুমোদিত কোনো বাজার না, রাস্তায় বসানো বাজার। এলাকার লোকজন চালায়। এতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচলে ভোগান্তি হয় এটা সত্য। এ বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মহাখালীর কাঁচাবাজারের পশ্চিম পাশের ফুটপাতটি বেশ প্রশস্ত। কিন্তু এ চওড়া ফুটপাত যেন পথচারীদের ব্যবহারের জন্য নয়। হকার, পার্কিং করা গাড়ি ও স্থানীয় দোকানদারদের দখলেই রয়েছে পুরো ফুটপাত। ওই এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, মহাখালী ফ্লাইওভার ও তিতুমীর কলেজ রোড থেকে কাঁচাবাজার হয়ে মহাখালী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত পুরো এলাকায় বিভিন্ন পণ্যের পসার সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। জুতা, শীতের পোশাক, মোবাইল রিচার্জ, চা-সিগারেট ও ফলের দোকান নিয়ে বসেছেন তারা।

মহাখালী কাঁচাবাজারের ক্রেতাদের গাড়িও ফুটপাতের দুপাশ দখল করে রেখেছে। বাজারের রূপালী ব্যাংকের সামনে ছোট পার্কিং জায়গাটি ছাড়াও ফুটপাতের বেশ খানিকটা অংশজুড়ে রাখা হয়েছে এসব গাড়ি। আর ফুটপাতের ওপর বসেছেন শতাধিক হকার। শুধু ফুটপাতই নয়, যেখানে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করা বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন থামার কথা সেখানে হকাররা দোকানপাট বসিয়েছেন। এমনকি প্রধান সড়কের ওপরও রয়েছে দোকান।

ফুটপাত ও সড়ক দখল করে দোকানপাট বসানোর কারণে এ এলাকায় প্রতিনিয়ত লেগে থাকে যানজট। পথচারীদের বাধ্য হয়ে সড়ক দিয়েই চলতে হয়। এ যানজটের প্রভাব মহাখালী এলাকা ছাড়াও বনানী, গুলশান, বাড্ডা, বিজয় সরণিতেও পড়ে বলে বাসচালক, যাত্রী ও স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে ফুটপাত দখল করে রাখায় বাধ্য হয়ে পথচারীদের প্রধান সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হয়।

পুলিশের চোখের সামনে এসব দোকানপাট বসিয়ে দিব্যি বেচাকেনা করে যাচ্ছেন হকাররা। দোকানিদের দাবি—বাজারের পাশে ফুটপাতে ব্যবসা করতে হলে বিভিন্ন দিকে টাকা দিতে হয়। বাজারের কিছু লোক, পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন বলেও তারা অভিযোগ করেন।

হকার মুখলেছুর রহমান জানান, তিনি দীর্ঘদিন সেখানে কাপড়-চোপড় বিক্রি করছেন। বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনের লোকজন উচ্ছেদ করতে আসেন। পুলিশও আসে। এর মধ্যেই বিভিন্ন দিকে টাকা-পয়সা দিয়ে সেখানে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের দুই পাশের জায়গা দখল করে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভাসমান দোকানিরা। আর কতিপয় করছেন গাড়ি পার্কিং। সড়কে গাড়ি পার্কিং বা বাজার বসাতে সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারের কোনো সংস্থা ইজারা কিংবা অনুমোদন দেয়নি। তারপরও সড়ক দখল করে এসব করা হচ্ছে। ফলে জনভোগান্তির পাশাপাশি বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনাও। আর তাই এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি সমাজ সচেতনদের।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ