পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে থমকে গিয়েছিল ধরিত্রী। ফুঁপিয়ে কাঁদছিল বাতাস। যে মানুষটি একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিলেন, তাকেই সপরিবারে প্রাণ দিতে হলো।
এমন বিশ্বাসঘাতকতা বোধহয় আর কখনো দেখেনি প্রকৃতি। রক্তঝরা সেই আগস্টের ১৩তম দিন আজ। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট ছিল বুধবার।
শোকের এই মাসে বাঙালি জাতি আজও গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণ করে। স্মরণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কবির ভাষায়-‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো/ যদি বাঙালি হও নিঃশব্দে কাছে এসো, আরো কাছে/... এখানেই শুয়ে আছেন অনন্ত আলোয় নক্ষত্রলোকে/ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের যানগুলো সচল হয়ে ওঠে। ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণে অবস্থিত ইউনিট থেকে ১০৫এমএম কামানগুলো ট্রাক দিয়ে টেনে নির্মাণাধীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় নিয়মিত নৈশ প্রশিক্ষণের জন্য।
রাত ১০টার দিকে সেনানিবাসের উত্তরপ্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে পড়ে। এয়ারপোর্টে ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক একত্রিত হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ প্রমুখ সেখানে জড়ো হয়।
১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে মেজর ফারুক অফিসারদের নির্দেশ দেয় বিমানবন্দরের কাছে হেডকোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন অফিসে মিলিত হতে। অফিসারদের অপারেশনের পরিকল্পনা জানায় মেজর ফারুক। সে ছিল এই অপারেশনের দায়িত্বে। প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাড়ি সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ওই বাড়ি ঘিরে দুটো বৃত্ত তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। আরও সিদ্ধান্ত হয়, ভেতরের বৃত্তের সদস্যরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে।
বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা ভেতর থেকে সেনাবাহিনীর কোনো আক্রমণ এলে তা ঠেকানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় বাইরের বৃত্তের সদস্যদের। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর নূর ও মেজর হুদাকে। সিদ্ধান্ত হয়-তারা ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড, সোবাহানবাগ মসজিদ এবং ৩২ নম্বর ব্রিজে রোড ব্লক করবে।
প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাসা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ধানমন্ডিতেই শেখ ফজলুল হক মনি এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণেরও সিদ্ধান্ত হয়। এভাবেই ঠান্ডা মাথায় ঘাতকের দল রচনা করে বাঙালির সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি বাংলাদেশকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশটিকে। সেদিন ঘাতকরা হত্যা করেছিল পিতার নশ্বর শরীরকে, কিন্তু তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘাতকের সাধ্য ছিল না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্বকে বিনাশ করার।
সৈয়দ শামসুল হক তার ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন- ‘এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;/তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-/চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।’
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ