ঢাকা, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আবাসিকে অহরহ বস্তিতে ‘অবাক’ কম

প্রকাশনার সময়: ০৮ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৫১

হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে বড় হচ্ছে ডেঙ্গুআক্রান্তে মৃত্যুর তালিকা। প্রতিদিন এডিস মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েকশ’ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তির রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা।

সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রকোপ ঢাকায় বেশি লক্ষ করা গেছে। তবে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও স্বস্তিতে রয়েছে বস্তিবাসীর বাসিন্দারা। আবাসিক ও অভিজাত এলাকায় ডেঙ্গুর দৌরাত্ম্য বাড়লেও বস্তিতে নেই!

বস্তিতে সাধারণ মানুষের জ্বর, ঠান্ডা হলেও ডেঙ্গুআক্রান্ত হয়েছিলেন বা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এমন কথা তাদের জানা নেই। জ্বর, ঠান্ডা, কাশি হলে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে এনে খেয়েই সুস্থ!

তারা বলছেন, চারদিকে শোনা যায় ডেঙ্গু আওয়াজ। তবে বস্তিগুলোতে ডেঙ্গুআক্রান্ত হয়েছে এমন ঘটনা শোনা যায় না। তবে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হতে হয়। ঘনবসতি হওয়ায় বস্তি এলাকায় ডেঙ্গুর বাহক কম বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, বস্তিগুলোতে গাছপালা, ঝোপঝাড় কম থাকায় সেখানে ডেঙ্গুর বংশ-বিস্তার কম। সেখানে পানি জমার সুযোগও থাকে কম। একটা ভবন বা আবাসিক এলাকায় অনেক খালি পাত্র পড়ে থাকে, কিন্তু বস্তিতে জনবসতি বেশি থাকায় সেখানে কনটেইনার বা পানি জমার পাত্র পড়ে থাকে না। এসব কারণে বস্তিতে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি কম।

রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে আবাসিক এডিস মশা। যেটাকে এডিস ইজিপ্টাই বলা হয়। ২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গু মহামারি হয় তখন বুনো ধরনের এডিস এলবোপিক্টাস (এডিসের আরেকটি প্রজাতি) হয়ে যায়। এখন ঢাকায় বুনো ও আবাসিক দুই ধরনের এডিসই ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। বস্তিতে সাধারণত গাছপালা, ঝোপঝাড় থাকে না। বুনো এডিস মশা যেহেতু ঝোপঝাড়ে বংশবিস্তার করে, তাই বস্তিতে এর প্রকোপ কম। অন্যদিকে আবাসিক এডিস মশা স্বচ্ছ টব, চৌবাচ্চার স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করে। বস্তিতে স্বচ্ছ পানির উৎস কম, এসব কারণে সেখানে ডেঙ্গুর প্রকোপও কম।’

রাজধানীর কয়েকটি বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি হলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কম। তবে দিনের বেলা থেকে শুরু করে তথা সন্ধ্যার পর মশার দৌরাত্ম্য বাড়লেও সেগুলো মশার কামড়ে ডেঙ্গুআক্রান্ত হয়েছে এমন ঘটনার কথা জানেন না তারা।

মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে মোল্লা বস্তির বাসিন্দা মোহাম্মদ বশির হাওলাদার বলেন, এই এলাকায় সিটি করপোরেশনের লোকজন মশা নিধন কর্মসূচি নিয়ে আসিনি। তারা কোনো ওষুধ দেয়নি। বিকেলের পর মশার জ্বালায় কোথাও বসার অবস্থা থাকে না। কয়েল দিয়েও কোনো কাজ হয় না। মশার কামড়ে হাত-পা ফুলে যায়।

তিনি বলেন, চারদিকে শুনি ডেঙ্গু হইছে। আমাদের এখানে একটা ছেলের ডেঙ্গু হইছিল গত মাসে। সিরিয়াস অবস্থা হয়ে গেছিল, পরে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এখন সুস্থ। কারও হইছে বলে শুনিনি। আমরা যে পরিবেশে থাকি, এডিস মশা এখানে নেই। করোনা, ডেঙ্গু কোনো কিছুই বস্তিতে নেই।

বাউনিয়া বাঁধ বস্তির বাসিন্দা আঞ্জুমান আরা জানান, তার ৭ বছরের মেয়ের জ্বর হয়েছিল গত মাসে। তবে হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো লাগেনি। সেটা ডেঙ্গু কিনা তার জানা নেই।

ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখীর মধ্যেই যেখানে স্বস্তিতে বসবাস করছেন বস্তিবাসী, সেখানে আবার উল্টো ঝুঁকিতে বসবাস করছেন আবাসিক ও অভিজাত এলাকার বাসিন্দারা। মশা নিধন কর্মসূচি পরিচালনা করেও একপ্রকার মশা নির্মূল করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কররেশন। ডেঙ্গু ঊর্ধ্বমুখী ঠেকাতে সঠিক কর্মপরিকল্পনা না থাকায় মহামারির শঙ্কাও করছেন তারা। আবার ভিন্ন সুরে কথা বলছেন ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সব সময় ১০ শতাংশের নিচে ছিল। এরই মধ্যে এই সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, ‘আমরা একটা কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে সমস্ত কার্যক্রম মনিটর করি। এটা একটা সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম। এখানে আমাদের মেয়র ফজলে নূর তাপস উপস্থিত থাকেন। প্রতিটি ডেঙ্গু রোগীর বাড়ি ধরে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছি।

তাছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আমাদের যে রিপোর্ট দেয়া হয়, সে অনুযায়ী যে এলাকাগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, গত তিন সপ্তাহে একাধিকবার সেসব এলাকায় চিরুনি অভিযান চালিয়েছি। চিরুনি অভিযান হলো, যে ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়, সেটিকে দশ ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগে সকালে এডিস মশার লার্ভা মেরে ফেলা এবং ফগিংয়ের মাধ্যমে উড়ন্ত মশা মেরে ফেলা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এডিস মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় (রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) সারাদেশে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৭ জন। একই সময়ে সারাদেশে ডেঙ্গুআক্রান্ত হয়ে নতুন করে আরও ৮৭৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪৯৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩৭৮ জন। এ নিয়ে দেশে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৩ হাজার ২৭০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গুআক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সর্বমোট ৪৩ হাজার ৯৮২ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪০ হাজার ৫৩৫ জন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবার হুট করে ডেঙ্গু চলে যাবে না। তবে প্রেডিকশন বলছে, ১৫ দিন পর থেকে কমতে শুরু করবে। পুরোপুরি যাবে না, কিছুটা দুর্বল হবে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে— জলবায়ু পরিবর্তন, শরীরে জীবাণু বাসা বেঁধে যাওয়া, মশা জন্মানোর জন্য কিছু স্থায়ী জায়গা, ওয়াসার মিটারে লিকেজ থাকা, পার্কিংয়ের জায়গাগুলোতে গাড়ি ধোঁয়া, এডিস প্রজননের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা, জানা থাকা সত্ত্বেও মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল আচরণ করা।

তিনি বলেন, এসব কারণে এডিস মশার বিস্তার প্রতিরোধ কঠিন হয়ে পড়ছে। আরেকটি কারণ হলো, অনেকেরই ধারণা, এডিস মশা ভোরে আর বিকেলে কামড়ায়। কিন্তু এটি ভুল। এডিস সব সময়ই কামড়ায়। মানুষের মতো প্রত্যেক প্রাণীর একটা অ্যাক্টিভ এবং ইনঅ্যাক্টিভ সময় আছে। তখন সে একেবারেই যে কাজ করে না, তা কিন্তু না। এডিস সাধারণত কিছু সময় একটু ইনঅ্যাক্টিভ থাকে। তার মানে এটা না যে একেবারেই কামড়ায় না। এই ধারণা থেকেও অনেকে ভোর এবং বিকেল বাদে অন্য সময় অসতর্ক থাকে। এতেও সে আক্রান্ত হতে পারে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ