মিটার টেম্পারিং, বাইপাস, অবৈধ সংযোগ চালানো, লোড বাণিজ্য, মিটার পরিবর্তন, অবৈধভাবে এইচটি লাইনের স্থলে এলটি লাইন টানাসহ সব কাজই করানো সম্ভব হয় ‘নগদ নারায়ণে’। তবে বৈধপন্থায় এসব কাজের যে কোনোটি করতে গেলেই পড়তে হয় বিপাকে। শিকার হতে হয় হয়রানির। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) আদাবর জোনে অনিয়মই পরিণত হয়েছে নিয়মে! এমনটাই অভিযোগ ডিপিডিসি আদাবর বিভাগে কর্মরত পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ভুক্তভোগীরা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর এসব অভিযোগ করেছেন।
ডিপিডিসির আদাবর বিভাগে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন—সহকারী প্রকৌশলী হাসান পারভেজ রূপক, উপসহকারী প্রকৌশলী ইলিয়ান জোয়ার্দার সুরভী, সিএস মিহির কুমার সরকার, এসএসএ (শ্যামলী সার্কেল) ইয়াসিন হোসেন পাটোয়ারি ও গ্রাহক সেবা ডেস্কের দায়িত্বে থাকা খন্দকার শফিউল আলম শফিক।
শ্যামলীর ভুক্তভোগী আবুল হোসেনের লিখিত অভিযোগে বলেন, আদাবরের সুনিবিড় হাউজিংয়ের রোড ৩ বাড়ি ৫৫, চন্দ্রীমা মডেল টাউনের ৫নং রোডের শেখ মোহাম্মদ মিল্টনের ৩০৩নং বাড়ি এবং একই আবাসিক প্রকল্পের ৩নং রোডের ১৫-১৬নং বাড়িতে কাঠামো অনুযায়ী এইচটি সংযোগ হওয়ার কথা। কিন্তু এসব হাউজিং এলাকায় ঘুষের বিনিময়ে দেয়া হয়েছে এলটি সংযোগ। চন্দ্রিমা মডেল টাউন প্রকল্প আবাসিক এলাকায় এইচটি লাইনের পোল বসানোর স্থলে এলটি লাইন করার অনেক প্রমাণ রয়েছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে দালালের মাধ্যমে এসব কাজ সুচারুভাবে করা হয় বলেও অভিযোগে প্রকাশ। ডিপিডিসির আদাবর ডিভিশনে গ্রাহককে যে কোনো কাজ করাতেই দালাল মাধ্যম হতে হয়। নয়তো বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগে জানা যায়।
অভিযোগ রয়েছে—ঘুষ ছাড়া এখানে কোনো কাজই করা সম্ভব নয়। যে ফাইলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ঘুষ পান, সেটির কাজই দ্রুত সম্পন্ন হয়ে যায়। আবার ঘুষ না পেলে সে ফাইল নড়ে না, দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয় টেবিলে। এমনকি দীর্ঘদিন পার হলে অনেক ফাইল হারিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে— ডিপিডিসির আদাবর বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী হাসান পারভেজ রূপক নির্ধারিত স্থানীয় কয়েক দালালের মাধ্যমে দাফতরিক অনেক অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে আদাবর ডিভিশনে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কথায় কথায় তিনি ডিপিডিসি এমডির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে প্রচার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সংস্থার এমডির সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতা প্রমাণে দম্ভ করে তিনি বলেন, আস্থাভাজন হওয়ার কারণেই আমাকে সিঙ্গেল দফতরাদেশে আদাবরে বদলি করে দিয়েছেন।
সহকারী প্রকৌশলী হাসান পারভেজ রূপককে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, ‘আপনি কি অনুসন্ধানী প্রতিবেদক? তাহলে খোঁজ-খবর নেন তাহলে জানতে পারবেন।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে কারও সঙ্গে তাদের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে নিষেধ রয়েছে। আপনি অনুমতি নিয়ে আসুন, তখন দেখা যাবে। এছাড়া আমি কিছুই বলতে পারব না।’ অভিযোগের অপর একটি দফায় বলা হয়, ‘আদাবর ডিভিশনের উপসহকারী প্রকৌশলী ইলিয়ান জোয়ার্দার সুরভী ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেন না। তার অধীনস্থ ফিডারগুলোর নতুন সংযোগের যত ডিমান্ড নোট ইস্যু হয় সেগুলো অফিসের নিয়মানুযায়ী গ্রাহক সেবার ডেস্কে থাকার কথা। কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রকৌশলী সুরভী নিজের ড্রয়ারে রেখে দেন। তিনি গ্রাহকদের ফোনে ডেকে এনে ঘুষের বিনিময়ে গ্রাহকদের কাছে ডিমান্ড নোট প্রদান করেন। এমনকি তিনি নিজেকে ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) গিয়াস উদ্দিন জোয়ার্দারের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে দাম্ভিকতা ও খবরদারি করেন। যার ফলে তার ঘুষ বাণিজ্য ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না বলে জানা যায়।
উপসহকারী প্রকৌশলী ইলিয়ান জোয়ার্দার সুরভীকে পরিচয় দিয়ে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘তিনি জানতে চান, আপনি কি দুদকে কাজ করেন? পুনরায় পরিচয় দেয়ার পর তিনি বলেন, ‘আপনি ফোন দিলেন এর আগে অন্য গণমাধ্যম থেকেও এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। আসলে আমাদের হেড অফিস থেকে এসব বিষয়ে কোনো ধরনের কথা বলতে নিষেধ রয়েছে। আমরা তো একটা অর্গানাইজেশনের আন্ডারে, আমাদের একটা রুলস আছে। তাই আপনাকে হেড অফিসের পিআরও ম্যাডামের অনুমতি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) গিয়াস উদ্দিন জোয়ার্দার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আদাবর জোনে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। কেউ আমাকে আত্মীয় পরিচয় দিচ্ছে এমন প্রমাণ পেলে আমি তাৎক্ষণিক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমি বংশ জোয়ার্দার এবং একই নামীয় জোয়ার্দার বংশের অন্য কেউ আমাকে আত্মীয় পরিচয় দিলেই তো সে আমার আত্মীয় হবে না।’ লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, সিএস মিহির কুমার সরকার সিবিএ সভাপতি হওয়ার পর থেকে ধরাকে সরাজ্ঞান মনে করেন। তিনি কারও অনুমতি ছাড়াই জোরপূর্বক গ্রাহক সেবা ডেস্কে বসে আগত গ্রাহকদের কী কাজে আসছেন জানতে চান এবং তা সমাধান করার নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ দাবি করে থাকেন। লোড বাণিজ্য, মিটার পরিবর্তন, অবৈধভাবে এইচটি-এলটি লাইন টানা এবং চন্দ্রিমা মডেল টাউন, ঢাকা উদ্যান এলাকায় প্রতি বাড়িতে গিয়ে তার ভিজিটিং কার্ড ও মোবাইল নাম্বার দিয়ে আসেন এবং গ্রাহকের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করেন। পরে গ্রাহককে ফোন করে অবৈধভাবে কাজ করে দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
এ ব্যাপারে সিএস মিহির কুমার সরকারের সঙ্গে তার মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগের অপর একটি দফায় আদাবর ডিভিশনের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক এসএসএ (শ্যামলী সার্কেল) ইয়াসিন হোসেন পাটোয়ারি বিরুদ্ধে উল্লেখ আছে, শ্যামলী সার্কেল ও এনওসিএস আদাবর দফতর একই ভবনে অবস্থিত। তাই তিনি নিজের কাজ ফেলে রেখে সারাদিন এনওসিএস দফতরে লোড বাণিজ্য ও বিভিন্ন কাজের দালালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তিনি ২০১৪ সালে এনওসিএস আদবের দফতর শুরু হওয়া থেকে অদ্যাবধি একই দফতরে কর্মরত রয়েছেন। তাই সে অত্র দফতরকে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করেন। একই দফতরে দীর্ঘদিন থাকার কারণে তিনি এলাকায় অনেক পরিচিত। সে হিসেবে তিনি অনেক অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং অফিস শেষে তার নেতৃত্বে অত্র দফতরের ছাদে বহিরাগত লোকজন নিয়ে জমজমাট জুয়ার আসর বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও সিবিএর সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস পায় না।
গ্রাহক সেবা ডেস্কের খন্দকার শফিউল আলম শফিকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘তিনি ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ওই দফতরেই কর্মরত আছেন। তখন থেকেই তার বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অবৈধ কাজ করার অভিযোগ উঠে। অনেক অভিযোগ ডিপিডিসি হেড অফিসে তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়। হেড অফিস অভিযোগের তদন্ত করে এবং তার ঘুষ, দুর্নীতির সত্যতা পায়। তারপরও অদৃশ্য কারণে এখনও তিনি বহাল তবিয়তে থেকে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘুষ ছাড়া তার কাছ থেকে গ্রাহকরা কোনো সেবা পায় না। ডিপিডিসির আদাবর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী শের আলী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমি নিজে কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নই আর কাউকে করতেও দেবো না। দেশের স্বার্থে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তারপরও বলব হয়তোবা শতভাগ দুর্নীতি মুক্ত এখনও করতে পারিনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা জানান, ‘আদাবর ডিভিশনের উল্লেখিত ওই পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় এক বছর আগে একই ধরনের আরও একটি অভিযোগ করা হয়েছিল।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ