ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দাদন দিয়ে ‘চোর’ পালন

প্রকাশনার সময়: ৩০ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৪

রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও দনিয়া এলাকায় গড়ে উঠেছে চোরাই স্বর্ণ কেনা-বেচার একটি শক্তিশালী ব্যবসায়ী চক্র। এই চক্রের অনেকে দাদন (অগ্রিম টাকা দিয়ে) দিয়ে চোর পালেন, আবার অনেকে চোরদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে চোরাই স্বর্ণ কিনে থাকেন। এরপর তা গলিয়ে নতুন গহনা বানিয়ে বাজারজাত করেন। এ ধরনের তথ্য থাকার পরও প্রমাণের অভাবে চক্রের সদস্যদের কাছে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে এই চক্রের সদস্য ইমন, আকাশ ওরফে সায়মন ও সৌরভকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেখানে দেখা যায়, অসাধু ব্যবসায়ীরা রীতিমতো অগ্রিম টাকা দিয়ে চোরের সঙ্গে সখ্য রাখেন। ফলে বাধ্য হয়ে চোরাই স্বর্ণ ওই দোকানেই তাদের বিক্রি করতে হতো। কোনো কারণে বিক্রি না করলে সে খবর চলে যেত পুলিশের কাছে। এ কারণে ঝামেলা এড়াতে ব্যবসায়ীদের শর্ত মেনেই চক্রের সদস্যরা মাঠে কাজ করে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ জোনের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘চোরাই স্বর্ণ কেনা-বেচার জন্য পুরান ঢাকায় একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। চক্রের অসাধু সদস্যরা অগ্রিম টাকা দিয়ে চোর পালে। তারা সবাই ব্যবসায়ী। চোররা ধরা পড়লে আবার তাদের আদালত থেকে ছাড়িয়ে আনারও দায়িত্ব রয়েছে ওইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের।’

জানা গেছে, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় স্বর্ণবন্দক রাখার ব্যবসা করেন রনি দত্ত। প্রকাশ্য এই ব্যবসার আড়ালে কম দামে স্বর্ণ ও গহনা বিক্রির জন্য তার বিশেষ পরিচিতি আছে। কিন্তু কীভাবে সে বাজারদরের চেয়ে কমে তা বিক্রি করে? কে বা কারা তাকে এই স্বর্ণ সরবরাহ করে? তা ছিল অজানা। গোয়েন্দা পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সরবরাহকারীরা আর কেউ নয়, সবাই তার ‘পোষা’ লোক। এজন্য তাদের নিয়মিত অর্থ দেয় রনি। আবার অপকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়লে তাদের জামিনের ব্যবস্থাও করে। বিনিময়ে চুরি-ডাকাতি করে পাওয়া স্বর্ণ বেশ কম দামে তার কাছে বিক্রি করে চোররা। পরে সেগুলো গলিয়ে খাঁটি স্বর্ণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, তাঁতীবাজারে নীলাদ্রি গোল্ড হাউস নামে একটি দোকান আছে রনির। অন্তত পাঁচ বছর ধরে সে চোরাই স্বর্ণের কারবারে যুক্ত। ১০-১২ সদস্যের একটি চোরের দল রয়েছে তার। এই চোররা দিনে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। যেখানে নিরাপত্তার ঘাটতি থাকে এবং তালাবদ্ধ কোনো বাসা বা অফিস পায়, সেখানেই তারা ঢুকে পড়ে। যে কোনো ধরনের তালা ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিটের মধ্যেই ভাঙার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। এরপর ভেতরে ঢুকে মূল্যবান মালপত্র নিয়ে চম্পট দেয় তারা।

একই দলের সদস্যরা রাতে বিভিন্ন বাসা-অফিসের গ্রিল কেটে ভেতরে ঢোকে। পাশাপাশি ছিনতাই বা ডাকাতি করেও তারা স্বর্ণালঙ্কার, টাকা, মোবাইল ফোন লুট করে। এখন পর্যন্ত এ চক্রের আটজনের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের সাতজনকেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে চক্রের অন্যতম হোতা ইমন হোসেন ওরফে রেজগি ইমনের নামে কমপক্ষে ১০টি মামলা আছে। অপর সদস্যদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় কয়েকটি করে মামলা রয়েছে। এই দলটি গত পাঁচ-ছয় বছরে পঞ্চাশটির বেশি চুরির কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। আরও ১০টি স্থানে চুরির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে তারা।

ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, তাঁতীবাজার এলাকার সুতারনগরের উৎসব পোদ্দার লেনের ৭ নম্বর বাসা থেকে গত ১৫ জুন কিছু গহনা চুরি হয়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী বিথী খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, চোর ঘরের তালা ভেঙে ৫৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, একটি ডায়মন্ড সেট ও এক জোড়া পাথর সেটসহ মোট ৪৮ লাখ ৮০ হাজার টাকার গহনা নিয়ে গেছে। মামলাটির ছায়াতদন্ত শুরু করে ডিবি লালবাগ বিভাগ। একপর্যায়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর চুরিতে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। তাদের মধ্যে ইমন, আকাশ ওরফে সায়মন ও সৌরভ সরাসরি চুরিতে জড়িত। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে তারা সে কথা স্বীকার করেছে। গ্রেফতার আকাশ সাহা চোরাই স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও রনি দত্তের শ্যালক।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, চোরাই স্বর্ণের কারবারের নেপথ্যে রয়েছে রনি। সে কেরানীগঞ্জের আরেক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে। তাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয় ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তার চোর পালনের কাহিনি। তার দেয়া তথ্যে জব্দ করা হয় চোরাই স্বর্ণ বিক্রি করে পাওয়া ৫ লাখ টাকা।

ডিবি সূত্র জানায়, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী স্বর্ণের ভরি ৮২ হাজার টাকার বেশি। তবে চোরাই স্বর্ণ মাত্র ৬৮ হাজার টাকা ভরিতে কেনে রনি। সেগুলোর ওজন নিয়েও রয়েছে ফাঁকিবাজি। তাঁতীবাজারের চুরির ঘটনায় বাদী ৫৩ ভরি স্বর্ণের কথা উল্লেখ করেন। তবে রনি তার পোষা চোরদের কাছে গহনাগুলো নিয়ে জানায়, সেখানে সাড়ে ১২ ভরি রয়েছে। এ বাবদ সে সাড়ে ৮ লাখ টাকা দিয়েছে। এরপর দ্রুত স্বর্ণ গলিয়ে হলমার্ক দিয়ে তা অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। দু’দিনের রিমান্ড শেষে গত সপ্তাহে তাকে আদালতে হাজির করে ডিবি।

ডিবির কোতোয়ালি জোনাল টিমের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল আলম মুজাহিদ বলেন, রনির নামে তিনটি মামলা রয়েছে। তার চক্রের আরও দুই সদস্য অন্য মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে। তারা হলো— সুজন ওরফে বাবু ও রাকিব ওরফে জসীম। এ ছাড়া রাসেল নামে একজন পলাতক আছে। চক্রের অপর সদস্যদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। চোরাই স্বর্ণের আরেক কারবারি রাজধানীর দনিয়ার দিপা জুয়েলার্সের মালিক লিংকনকেও খুঁজছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধেও চোর পালার অভিযোগ রয়েছে। তাঁতীবাজার এলাকায় অভিযানের পর সে গা-ঢাকা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে খুব দ্রুতই তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে আশাবাদী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ