দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে অংশ করার কথা ভাবছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। তবে নির্বাচন এককভাবে লড়াই করার মতো শক্তি দলটির নেই। সম্ভাব্য ৫২ আসনে প্রার্থীর তালিকা তৈরি করলেও নেই ৩০০ আসনের যোগ্যপ্রার্থী। ফলে জোটগতভাবে নির্বাচন করা ছাড়া জাপার সামনে বিকল্প নেই।
আবার দর-কষাকষি করে জোট থেকে বেশি আসন বাগিয়ে নেয়ার মতোও অবস্থান নেই। আর এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) অন্তর্কোন্দল। পৃথকভাবে কাউন্সিল ডাকা নিয়েও দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
যদি জাপা দুই ভাগে বিভক্ত হয় তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে পার্টির ভোট ও আসনসংখ্যা আরও কমে যাবে। জনগণের সমর্থক দিক দিয়েও অনেক পিছিয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক মহলেও গুরুত্ব হারাবে। আর ‘ট্রামকার্ড’ হিসেবেও হয়তো জাতীয় পার্টিকে বিবেচনা করবে না বড় দুই দল। জাপার বিভিন্ন সারির নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে মিলেছে এমন তথ্য।
জাতীয় পার্টির একাধিক নেতাকর্মীরা বলছেন, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পদ ও মনোনয়নবাণিজ্যের কারণে দলটির এখন ভঙ্গুর অবস্থায়। নেই সঠিক নেতৃত্বও। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রওশন এরশাদের ডাকা কাউন্সিল দ্বন্দ্ব।
রওশনের ডাকা কাউন্সিল হয়ে জাপার লাভ হবে না ক্ষতি হবে তারও হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে নেতাকর্মীরা। প্রভাব পড়ছে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমেও। কার হাতে নেতৃত্ব যাবে রওশন, জি এম কাদের নাকি দলে আসবে অন্য কেউ? তা নিয়ে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে খোদ দলের মধ্যে। এই পরিস্থিতি দলের জনসমর্থন ও ভোট কমছে বলে আশঙ্কা করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাপাকে ‘ট্রাম কার্ড’ বলা হতো। তার মৃত্যুর পর ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে জাতীয় পার্টি। গুরুত্বও কমে গেছে কূটনৈতিক মহলে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে।
এরশাদের নেতৃত্বে আমলে কূটনৈতিক মহলে সবসময় জাপা আলোচনায় থাকত। এখন আর তা নেই। এখন জাতীয় পার্টিকে বলা হয় ‘আমাকে ব্যবহার করুন’ (ডাস্টবিন)। দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকেও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল করা হয়। তবে রুটিন ওয়ার্ক এবং জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসেবে ঢাকার বিদেশি হাইকমিশনে এখনও ডাক পান জাতীয় পার্টির নেতারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপার বর্তমান কর্মকাণ্ডে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এবং সম্ভাব্য প্রার্থীরাও হতাশ।
সূত্রমতে, জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করেছিল ১৯৯১ সালে। এরপর থেকে সব নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিয়েছে। বর্তমানে শুধু রংপুর বিভাগের মানুষ জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব আছে। অনেক মহানগর-জেলা-উপজেলায় জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব নেই। জোটগতভাবে নির্বাচনের ফলে ২৪৮টি আসনে জাতীয় পার্টির নির্বাচনি প্রতীক কি তাও হয়তো জানে না সাধারণ মানুষ। ওইসব আসনে সংগঠনের কার্যক্রমও তেমন নেই। এরপরও দলের মধ্যে ৫২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর একটি তালিকা তৈরি করেছেন জি এম কাদের। তাই দলটির নেতাদের দাবি জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রতিটি জেলার অন্তত একটি আসন ও বিভাগীয় শহরের দুইটি আসন নিশ্চিত করতে হবে। এতে দলটির জেলাভিত্তিক সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি ফিরে আসবে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে হুসইেন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর, রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হতে পারেনি। দলীয় নেতাকর্মীরা ভেবেছিলেন দলটি রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকবে তো— এ সংশয় ছিল সবার মাঝে। তবে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে এককভাবে জাপা অংশ নিয়ে ৩৫টি আসনে জয়লাভ করে।
এরপর দলটির নেতাকর্মীরা চাঙা হতে থাকেন। ওই সময় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরী। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কাছে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব ছিল। গত ১৫ বছর ধরে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বেড়েছে ঠিকই। তবে পাশাপাশি দলটির ওপর থেকে বিশ্বাসও হারিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
তারা মনে করেন, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে, জাতীয় পার্টি যত ভোট পেয়েছিল সেটি পরে ক্রমাগত কমেছে। জাতীয় পার্টির ভোট বা সমর্থনগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দিকে চলে গেছে। তাদের মতে, আগামী নির্বাচনের পর জাপার জনসমর্থন আরও কমবে। তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন মত জাপা নেতাদের। তারা মনে করেন, বিএনপি যদি সমর্থনের দিক থেকে নিচের দিকে চলে যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় পার্টির সমর্থক সংখ্যা বা ভোটার সংখ্যা বাড়বে।
নাম প্রকাশে জাপার একজন অতিরিক্ত মহাসচিব নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এখন রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি লিমিটেড কোম্পানি। জি এম কাদের সাহেব এটির সিইও। আমরা যারা আছি সবাই এখানে এমপ্লয়ি। যে কোনো সময় আমাদের চাকরি চলে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, জি এম কাদের নিজের আত্মীয়-স্বজনকে দলে ঢোকাচ্ছেন এমপি বানানোর জন্য। যেমন আদেলুর রহমান আদেল এমপি, তিনি কোনোদিন রাজনীতি করেননি। অথচ দলীয় এমপি। আমরা কিন্তু দলের জন্য অনেক কিছু করেছি কিন্তু কিছুই হইনি। সেহেতু জাপার অবস্থা আগামীতে খুবই শোচনীয় হবে। এটা স্বাভাবিক।’
জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির আসন কমছে না বাড়ছে তা এখন বলা যাচ্ছে না। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি, নির্বাচনের জন্য প্রার্থী সেটআপ করছি। নির্বাচনের ৩ মাস আগে বলা যাবে আমাদের আসন বাড়বে না কমবে। জাতীয় পার্টিও আসন কমবে না বাড়বে সে বিষয়টি সাংবাদিকরা ভালো বলতে পারবে। তবে কোনো সাংবাদিক বলবে কমবে, আবার কোনো সাংবাদিক হয়তো বলবে কমবে না। কারণ সাংবাদিকরা মাঠে থাকছেন।’
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ও প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইদুর রহমান টেপা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হচ্ছে। জাপা আগের চেয়েও প্রার্থী সংখ্যা বাড়ছে। কারণ হিসেবে বলছে, একসময় খুলনা বিভাগে জাপার দলীয় প্রার্থী দেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সেখানে দলয় প্রার্থী দেয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম প্রত্যেকটি বিভাগে জাপার অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। সে হিসেবে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলে আসন সংখ্যা আগের তুলনায় বাড়বে। আর জোটগত নির্বাচনে অংশ নিলে সে ক্ষেত্রে দর কষাকষিতে যত আসন পাওয়া যায়।’
অবশ্য তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফলাফল করবে। আসন সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। তবে কত আসন পাবে তা অগ্রিম বলা যাচ্ছে না।’
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ