রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে নামিদামি কোম্পানির নকল মোবাইল ফোন। আর এসব ফোন তৈরি করা হচ্ছে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে। এতে একদিকে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
অন্যদিকে নিম্নমানের চার্জার ও ব্যাটারি ত্রুটিপর্ণূ হওয়ায় প্রায়ই বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঘটছে হতাহতের ঘটনাও। আবার আইএমইআই নাম্বার সঠিক না থাকার কারণে এ ধরনের ফোন ব্যবহারের তালিকার শীর্ষে অপরাধীরা। ফলে অপরাধীদের গ্রেফতারে প্রায়ই বাড়তি বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করা হলেও উদাসীন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। সম্প্রতি নকল ‘নকিয়া’ মোবাইল ফোন তৈরি করার সময় মোতালিব প্লাজা থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। এমন পরিস্থিতিতে ৯ সতর্কতা ও ৮ ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার জনাব মো. জুনায়েদ আলম সরকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, নকিয়া কোম্পানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ অক্টোবর মোতালিব প্লাজায় অভিযান চালিয়ে ৬ জনকে ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ উদ্ধার করা হয়। ওইসব যন্ত্রাংশ ভুল তথ্য দিয়ে আমদানি করা হয়েছিল বলে তদন্তে ওঠে আসে। এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৯ সতর্কতা ও ৮ ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব বিষয় মেনে চললেই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন ডিবির এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় আরও একাধিক ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় নকল মোবাইল ফোন বিক্রি করছেন। যাচাই-বাছাই শেষে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।
জানা গেছে, গত ৯ অক্টোবর শাহবাগ থানাধীন হাতিরপুলের মোতালিব প্লাজায় অভিযান চালায় ডিবি। এ সময় গ্রেফতার করা হয় মো. মশিউর রহমান, মো. সাগর হোসেন, রহমত আলী, সুজন আলী, তরিকুল ইসলাম বাবু ও মনির হোসেনকে। এদের মধ্যে মশিউর রহমান ও সুজন আলী নকিয়া মোবাইল ফোন তৈরির কারখানার মালিক। কারখানার মূল কারিগর রহমত আলী। বাকি সদস্যরা খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা। এই চক্রের সদস্যরা ৫/৬ বছর ধরে নকল মোবাইল ফোন বিক্রি করে আনুমানিক ৬ কোটি টাকার উপার্জন করেছে।
জানা গেছে. নকল এসব ফোন কেনায় সাধারণ মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে ক্রেতারা কল ড্রপ ছাড়াও নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর এ ধরনের নকল মোবাইল ফোনের অন্যতম ক্রেতা বিভিন্ন অপরাধী চক্র। নকল মোবাইল ফোন ও আইএমইআই নাম্বার ভুল হওয়ার কারণে অনেক সময় অপরাধীদের গ্রেফতারেও বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।
সূত্রমতে, মূলত চীন থেকে নকল মোবাইল ফোন তৈরির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে হাত বদল হয়ে তৈরি হওয়া নকল ফোন বাজারজাত হচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রথম স্তরের অপরাধীরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চীন থেকে নিম্নমানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন তৈরির যন্ত্রাংশ যেমন, মাদারবোর্ড, ডিসপ্লে, ক্যামেরা, কেসিং, ব্যাটারি, চার্জার, হেডফোনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই বাংলাদেশে আমদানি করে।
এরপর দালালের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্তরের ব্যবসায়ীদের কাছে এসব মালামাল বিক্রি করা হয়। পরবর্তীতে অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রথম স্তরের আমদানিকারকদের কাছ থেকে সংগৃহীত মোবাইল তৈরির যন্ত্রাংশ পাইকারি দরে কেনে। তারপর নিজস্ব কারিগর দিয়ে অ্যাসেম্ব্বলের মাধ্যমে ভুয়া আইএমইআই যুক্ত নকল মোবাইল ফোন প্রস্তুত এবং বাজারজাতকরণের সবব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
তিনি বলেন, এসব নকল মোবাইল ফোনে ব্যবহূত লোগো, স্ট্রিকার এবং প্যাকেটগুলো স্থানীয় বিভিন্ন প্রেসে তৈরি করা হয়। এরপর প্যাকেটজাত করে ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করে। এ ঘটনায় ওই দোকান থেকে নকিয়া মোবাইল ফোনের বিভিন্ন মডেলের ৩১৩টি নকল মোবাইল ফোন, স্যামসাং ব্র্যান্ডের ২০৬টি নকল মোবাইল ফোন, KINGSTAR IMPULSE SEALER (মডেল নং- PFS-200 মেশিন), একটি HOT AIR GUN, (মডেল নং- HG2008), SL NO-18032052, মোবাইল ফোন ক্যামেরা ৯৭টি, মোবাইল বডি কভার ৮২০টি, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল মোবাইল ফোন তৈরির খুচরা যন্ত্রাংশ, (ওজন অনুমান-১৫ কেজি)। যা দিয়ে আনুমানিক ৪-৫টি নকল মোবাইল ফোন তৈরি করা সম্ভব।
জানা গেছে, এ ধরনের ঘটনার পর ডিবি পুলিশ মোবাইল ফোন কেনার ক্ষেত্রে ৯টি সতর্কতা অবলম্বন করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে, KYD স্পেস ১৫ ডিজিটের আইএমইআই নম্বর লিখে ১৬০০২ নম্বরে সেন্ড করা, ফোনের গুনগতমান সূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই করা, একটি অরিজিনাল ফোন ২/৩ বছর ব্যবহার করা গেলেও নকল ফোন মাত্র ৩/৪ মাস ব্যবহার করলেই নষ্ট হয়ে যায়, নকল মোবাইলের বাটনগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো থাকে, নকল মোবাইল ফোনের ফন্টসমূহ তুলনামূলকভাবে ছোট থাকে, মোবাইলের স্ক্রিন/ডিসপ্লে ঝকঝকে পরিষ্কার থাকে না, নকল মোবাইলের ক্যামেরা খুব দুর্বল, নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা লাজুকও ভুয়া তথ্য সংবলিত ব্যাটারি স্টিকার ব্যবহার করে থাকে।
এ ধরনের ফোন ব্যবহারে ৮ ধরনের ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, ফোনের নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, নকল মোবাইলে ম্যালওয়্যার আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, র্যানসমওয়ার ভাইরাস আক্রমণের মাধ্যমে গুরত্বপূর্ণ ফাইল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা, সঠিক সময়ে আপডেট না হওয়ায় অচল হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি, নেটওয়ার্ক ত্রুটিপর্ণূ হওয়ায় কলড্রপ হওয়া, নিম্নমানের যন্ত্রাংশ রাসানিক বিক্রিয়ায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করা ও নিম্নমানের চার্জার ও ব্যাটারি ত্রুটিপর্ণূ হওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ