রমজান আলী (৬৫)। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগে। বৃদ্ধ রমজান মিথ্যা মামলার ঘানি টানছেন প্রায় ৩৫ বছর ধরে। আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে কেটেছে জীবনের বেশিটা সময়। অভাবের সংসারে নানা টানাপড়েন থাকলেও বছরের পর বছর টেনে যেতে হয়েছে মিথ্যে মামলার হাজিরা। এখনও রয়েছে কয়েকটি মামলা। কয়েকটি মামলা থেকে মিলেছে পরিত্রাণ।
নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মামলাবাজ একটি চক্রের সন্ধান। চক্রের মূলহোতা হরিরামপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার বিএনপি নেতা লাল মিয়া ও তার ছেলে সাইদুল ইসলাম। এই দলে রয়েছে মেয়ের জামাই জামায়াত নেতা মনির। এই পারিবারিক চক্রের হাতিয়ারই হচ্ছে মিথ্যা মামলা দায়ের আর জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি।
ভুক্তভোগী রমজান আলী নয়া শতাব্দীকে জানান, ১৯৮০ সালে বাবা আবদুল গফুর মারা যাওয়ার পর জানতে পারি আমাদের দিয়াবাড়ি মৌজায় এবং নলভোগ মৌজায় ৯ একর তিরানব্বই শতাংশ জমি ছিল- যা দখলে নিয়ে ২০ ব্যক্তির নামে মালিকানা বদল করেছেন চাচাতো ভাই লাল মিয়া ও তার ছেলে সাইদুল ইসলাম। পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পেতে গিয়ে মামলা খেয়েছি প্রায় ১০-১৫টি। যার কয়েকটি মামলা থেকে খালাস দিয়েছে আদালত। এক মামলায় ১৮ মাস জেলও খেটেছেন তিনি। একটি ডাকাতি মামলায় সাজাও হয়েছে এই বৃদ্ধের। তিনি জানান, আদালতে তাদের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করে দীর্ঘ ২৫ বছর মামলা চালিয়ে নলভোগ মৌজার ৩১ শতাংশ জমি কোর্টের মাধ্যমে বুঝে পেয়েছেন।
কী অভিযোগ এনে মামলায় জড়িয়েছেন জানতে চাইলে রমজান জানান, তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ’ করে চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাসী ও অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে বছরের পর বছর কারাগার আর আদালতেই রেখেছে। আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হতো।
সরেজমিন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। কাগজপত্রেও মিলেছে সত্যতা। অভিযোগ উঠেছে, আসল কাগজপত্র না থাকায় জাল-জালিয়াতি করে তৈরি কাগজপত্রের বৈধতা দেখাতে বিভিন্ন পত্রিকায় মিথ্যা হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চক্রটি। এমন অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে সরেজমিন গিয়ে লাল মিয়া মেম্বারকে না পেয়ে তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল দিলে তিনি অভিযোগের জবাব না দিয়ে ঘুরে-ফিরে নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকেন। কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি সময় নেন। তবে নির্ধারিত দিন পার হয়ে গেলেও তা দেখাননি।
অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে জানতে লাল মিয়ার ছেলে তার বাবার (লাল মিয়া) ফোন থেকে কথা বলেন। সব অভিযোগ অস্বীকার করে ছেলে সাইদুল রহমান বলেন, ‘তারা যা অভিযোগ করেছেন সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমরা যে মালিক তার সব দলিলপত্র রয়েছে। হয়রানি করতে এমন মিথ্যা অভিযোগ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আসল দলিলপত্র হারিয়ে গেছে। সেজন্য উত্তরা পশ্চিম থানায় জিডি করে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। তার বক্তব্যের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের বিষয়টির সত্যতা মিলেছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০০ সালের আগে ও পরে যারা তুরাগে এবং উত্তরার তৃতীয় প্রকল্পের প্লট কিনেছেন তাদের অনেক মালিক এই চক্রের কাছে জিম্মি। উল্টো মালিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্পদ হারিয়ে ও মিথ্যা মামলায় আদালতের বারান্দায় ঘুরছে একাধিক ভুক্তভোগী।
রমজান আলীসহ কয়েক ভুক্তভোগী দাবি করে বলেন, ‘সংঘবদ্ধ এই চক্রের সদস্যরা রাতের আঁধারে অন্যের জমি বা প্লটে সাইনবোর্ড লাগিয়ে জমিটি প্রথমে দখলে নেন। পরে জমির মালিক প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। চক্রের মূলহোতা লাল মিয়া মেম্বার, ছেলে সাইদুল ও মেয়ের জামাই জামায়াত নেতা মনির। এই চক্রে আরও রয়েছে প্রায় ৪০-৫০ জনের জামায়াত-বিএনপি ঘেঁষা সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং বাহিনী।
অপর এক ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সেলিম নয়া শতাব্দীকে জানান, দিয়াবাড়ি বটতলা গোলচত্বর এলাকায় আমার সাড়ে চার কাঠার একটি প্লট লাল মিয়া মেম্বার ও তার ছেলে সাইদুল রাতারাতি দখল করে রেস্তোরাঁ তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। ভুয়া জাল কাগজপত্র বানিয়ে নিজের জমি বলে দাবি করছে। এ বিষয়ে আদালতে তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলাও করেছি আমি। নিজের জায়গায় গেলেই তারা ৪০-৫০ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে হামলা চালায়। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে আমিও মামলা করেছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাল মিয়া মেম্বারের এক আত্মীয় জানান, লাল মিয়ার রাজউকের একটি প্লট দখল করে বাবা-ছেলে। বিচার না পেয়ে জমি হারিয়ে হতাশায় লাল মিয়া নামের ওই ব্যক্তি মারা গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবা-ছেলে মিলে আমিরুল ইসলাম এবং জেসমিন আক্তারের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প অ্যাকোয়ার বা অধিগ্রহণ হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাওয়ার্ডের প্লট দখল করে রেখেছে বলে জানা গেছে।
জমি দখলের কৌশল সম্পর্কে জানা গেছে, আমিরুল এবং জেসমিন প্লটটি পাওয়ার পর লাল মিয়া নানা রকমের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্লটটির অ্যাওয়ার্ডের ৭৫ হাজার ৫০০ টাকার দুইটি ব্যাংক রসিদ দেন। এ সময় বাবা-ছেলে তাদের বলেন, জমি বিক্রি করে আরও কিছু টাকা দেবেন। কিন্তু তার কিছুদিন পর ৭ লাখ টাকার বিনিময়ে আবদুর রাজ্জাক নামের একজনের কাছে স্ট্যাম্প করে লাল মিয়ার মাধ্যমে বিক্রি করে দেন। সেখানে দেখা যায়, দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে সই করেন লাল মিয়া মেম্বার নিজেই। তার কিছুদিন পর প্রতারণা করার লক্ষে জমিটির মূল মালিক আমিরুল এবং জেসমিনের কাছে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে একটি স্ট্যাম্পে সই করে একটি ‘পাওয়ার দলিল’ করে নেন লাল মিয়া।
আমিরুল এবং জেসমিন আবদুর রাজ্জাক নামের একজনের কাছে প্লটটি বিক্রি করেন। পরে রাজউকের সমস্ত কিস্তিও পরিশোধ করেন। আবদুর রাজ্জাক আবার রফিকুল ইসলাম নামের অপর এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। রফিকুল ইসলাম জমিটি ক্রয় করে জমিতে গেলে দেখতে পান লাল মিয়া ও তার ছেলে সাইদুল প্লটটি দখল করে রেখেছেন। পরে রফিকুল ইসলাম জমিটির দখল উচ্ছেদ করতে না পেরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাসির উদ্দিনের ছেলে শফিকুল ইসলাম স্বপনের কাছে প্লটটির সব কাগজপত্র বিক্রি করেন। শফিকুল ইসলাম স্বপন রেজিস্ট্রি করতে গেলে দেখতে পান লাল মিয়া ও ছেলে সাইদুল রহমান প্লটটি নিজের দাবি করে একটি ‘পাওয়ার দলিল’ জমা দিয়েছেন রাজউকে।
এ বিষয়ে জমির মূল মালিক আমিরুল ইসলাম জানান, ‘আমি এবং আমার শ্যালিকা জেসমিন লাল মিয়াকে কোনো পাওয়ার দেই নাই। সে আমার কাছ থেকে জমিটি বিক্রি করার উদ্দেশে অ্যাওয়ার্ডের কাগজপত্র নিয়ে প্রতারণা করেছে। কাগজ নেয়ার সময় এক লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন পরে আর’ টাকা দেবেন বলে জানান কিন্তু আর কোনো টাকা-পয়সা দেয় নাই লাল মিয়া। বাবা-ছেলে প্রতারণা করে আবদুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তির কাছে জমিটি বিক্রি করে। তিনি আরও জানান, ‘আমাকে সই করতে বলেন। কেন সই করব জানতে চাইলে লাল মিয়া বলেন, জমির কাগজপত্র ওঠাতে আপনাদের সই প্রয়োজন। আবদুর রাজ্জাকের কাছে বিক্রির সময় লাল মিয়া নিজেও ২নং সাক্ষী ছিলেন। আমাদের সঙ্গে স্রেফ প্রতারণা করেছে বাবা-ছেলে মিলে।’
বর্তমানে প্লটটির মালিক দাবি করা ৫৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাসির উদ্দিনের ছেলে শফিকুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘প্লট রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে দেখি লাল মিয়া ও তার ছেলে সাইদুর রহমান রাজউকে একটি ‘পাওয়ার দলিল’ জমা দিয়েছে। কী কাগজপত্রের বলে জমা দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিজের জমি দাবি করে। কিন্তু কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। পরে আমি প্লটটির দখল থেকে সরে যেতে বললে আমার কাছে সাইদুল রহমান এক কোটি টাকা দাবি করেন। নয়তো প্লটটি দখল ছাড়বেন না। পরে আমি ক্রয়কৃত প্লটটিতে যেতে না পেরে উত্তরা র্যাব-১ বরাবর লাল মিয়া ও সাইদুল রহমানের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি।’
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ