ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্যর্থতা না কৌশল

প্রকাশনার সময়: ১৪ অক্টোবর ২০২২, ০৯:২০

অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিজেদের ‘প্রতিশ্রুতি’ রাখতে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করল কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। বুধবার গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ভোটে সিসিটিভি ক্যামেরায় অনিয়ম, কারচুপি ও জালিয়াতি ঘটনার প্রত্যক্ষ করে চটজলদি ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করে ইসি।

ইসির এমন পদক্ষেপে জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল, দুই সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সন্তোষ প্রকাশ করলেও অসন্তোষ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা অন্তত ১৫ জন প্রিসাইডিং অফিসার।

প্রিসাইডিং অফিসাররা ইসি বরাবর চিঠি লিখে দাবি করেন, নিজেদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রগুলোতে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ চলছিল। তবে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশে তারা ভোটগ্রহণ বন্ধ করতে বাধ্য হন। ইসি সূত্রে জানা যায়, সমরপড়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন মশিউর রহমান। তিনি নির্বাচন কমিশন বরাবর দেয়া চিঠিতে লেখেন, তার কেন্দ্রে ভোট সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশে তিনি ভোটগ্রহণ বন্ধ করেন।

সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফও একই তথ্য ইসিকে জানিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘আমার কেন্দ্রের ৮টি বুথেই সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছিল। দুপুর আড়াইটার মধ্যে ভোট পড়েছে ৮৯৫টি। কিন্তু ৩টার সময় কমিশনের নির্দেশে নির্বাচনকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

উদয়ন মহিলা কলেজের প্রভাষক প্রিসাইডিং অফিসার মাহমুদুল হাসান। তিনি বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বে ছিলেন। মাহমুদুল হাসান ইসি বরাবর স্বহস্তে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলামের নির্দেশে ভোটকেন্দ্র পরিত্যাগ করলাম।’

নলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্বে এ কে এম জুলফিকার হায়দার। ইসি বরাবর লেখা চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘নির্বাচনি কর্মকর্তা সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি এ কে এম জুলফিকার হায়দার প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ১১৩ নং নলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ৪৮০টি। আমরা বিকেল ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

মোংলারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. কামরুজ্জামান তার চিঠিতে লেখেন, ‘নির্বাচনি কর্মকর্তা সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মো. কামরুজ্জামান প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ১২৮ নং মোংলারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ৬৮৯টি। আমরা বিকেল ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

মুন্সিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রিসাইডিং অফিসার শাহ আলম লেখেন, ‘সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মো. শাহ আলম প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ৭৬ নং মুন্সিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে আনুমানিক ৬৫০টি। আমরা ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

এদিকে, পুরো নির্বাচনি এলাকায় ইসির এমন ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শিতা বলেছেন অনেকে। এটাকে ইসির ব্যর্থতাও বলেও উল্লেখ করছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। ভোটকেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদেরও ঠিকমতো পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এছাড়া যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে, সেখানে কেন্দ্রভিত্তিক ভোট স্থগিত করা যেত। তা না করে তদন্ত ছাড়াই সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ভোটগ্রহণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল গণমাধ্যমকে বলেন, গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন আপনারাও দেখেছেন। আমরাও দেখেছি। এ নিয়ে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা নিয়ে জনগণের মনে বিভ্রান্তি থাকতে পারে। কেউ আনন্দ পেয়েছেন, কেউ ব্যথিত হয়েছেন, কেউ সাধুবাদ জানিয়েছেন। তাই কিছু ব্যাখ্যা আমাদের দেয়া প্রয়োজন।

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অনেকেই বলেছেন কী করে প্রত্যক্ষ করলাম। আমরা সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করে প্রত্যক্ষ করেছি। খুব নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ও আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা এখানে আছে। সে বিষয়টা হয়তো অনেকের জানা নেই। আমরা হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা কমিশন নিয়েছে। কমিশন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিন্তু এক নয়।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ভোট বন্ধ করার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন একটা বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে— বর্তমান বাস্তবতায় যা সঠিক হয়েছে বলেই আমি মনে করি। কোনো পক্ষ গোপন কক্ষে অবস্থান নিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করে ফলাফল অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা করলে তো কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতেই হবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বুধবারের নেয়া পদক্ষেপে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি বেশ উজ্জ্বল হয়েছে। ভোটে শৃঙ্খলা ফেরাতে সামনেও তারা এ ধরনের উদাহরণ তৈরি করতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পুরো বিষয়টি পাতানো খেলা কিনা সামনে তা স্পষ্ট হবে। তবে বুধবারের ভোটে যা যা ঘটেছে তাতে মনে হয়েছে মাঠপর্যায়ে ইসির সক্ষমতার অভাব রয়েছে। প্রশাসনের কেউ ইসির কথা শুনছে না। ইসির উচিত ছিল পরিস্থিতি দেখে আগেই ব্যবস্থা নেয়া। জানা যায়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভোট বন্ধের ক্ষমতা ইসিকে দেয়া আছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তা ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। কারণ একটি আসনের ভোট বন্ধ হলে জনমনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার ও প্রার্থীদের আর্থিক ক্ষতি হয়। এজন্য যেসব কেন্দ্রে সমস্যা হয়, সেসব কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়।

নির্বাচন কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, আমার জানা মতে এভাবে পুরো আসনের ভোট বন্ধের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। তবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জনগণের প্রতিরোধের মুখে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের এক উপজেলায় ভোটগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পুরো এলাকায় নির্বাচন বন্ধ করে দেয়াটা এই প্রথম।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ