গত এক বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। যা খাদ্যপণ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়লেও আয় বাড়েনি। ফলে সঞ্চয় করা কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। তাই এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ওপর। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সুদের হার কমানো এবং বেশ কিছু কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খাতেও খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আগস্টে মাত্র ৮ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই আগস্টের চেয়ে গত বছরের আগস্টে ৪৪৯ গুণ বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, এই বছরের জুলাইয়ের চেয়ে গত বছরের জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র খাতে সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল।
অর্থবছরের দুই মাসের হিসাবে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৪০১ কোটি ২০ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৭৩২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ের চেয়ে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সঞ্চয়পত্রে ১৪ দশমিক ২৯ গুণ বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল।
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি।
সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পরও বিক্রি বাড়ছিল। তবে গত কয়েক মাস ধরে বিক্রি বেশ কমেছে। এখন একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলেন, ‘এমনিতেই দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারও বেতন কমেছে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। এই ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এমনিতেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি ছিল। এরপর যুদ্ধের কারণে তা আরও বেড়ে গেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না।’
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরও ১০ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যায়। ব্যাংকে বা অন্য কোনোখানে টাকা রাখলে এত মুনাফা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হচ্ছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ; এখানে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই, মাস শেষে বা নির্দিষ্ট সময় শেষে সুদ-আসল পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাস শেষ হয়ে গেলেও আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আগের মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। কিন্তু তার ব্যত্যয় হওয়ায় অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। সেটা ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছতে পারে। সে কারণে সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করছে না বিবিএস।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যখন মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে দেরি হয়, তখন সরকারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সাধারণত প্রথম সপ্তাহেই মূল্যস্ফীতির তথ্য তৈরি হয়ে যায়। তা হলে এখনো দিচ্ছে না কেন? তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নীতি ঠিক করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কারসাজি করা হচ্ছে, তথ্য ঢেকে রাখা হচ্ছে। ৯-১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যা-ই হোক না কেন, এটা প্রকাশ করা উচিত। বিভিন্ন দেশ তাদের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে ফেলছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আরো ৩ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি বাড়বে।’
সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে গ্রাহকদের মূল টাকা (বিনিয়োগ) ও মুনাফা (সুদ) বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকারকে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫২ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যের চেয়ে এই খাত থেকে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কম ঋণ নিয়েছে সরকার।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে মোট ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৭০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়। সে হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে, ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ