দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি প্রায় ১৫ মাস। মসনদে বসতে মরিয়া প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। তাই নির্বাচন সামনে রেখে ফের বাড়ছে জোট রাজনীতির কদর। দল ও জোটগুলোর মধ্যে চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা। নতুন জোট গড়তে তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বসে নেই ছোট দলগুলোও।
আসন ভাগাভাগিসহ নানা বিষয় নিয়ে চলছে দেন-দরবার। ‘সরকার পতন’ একদফাতে একমত বিরোধী শিবির। মহাজোট থেকে বেরিয়ে এক দফা আন্দোলনে শামিল হতে পারে কয়েকটি ছোট দল। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ‘পাওয়া না পাওয়ার’ হিসাব নিয়ে চলছে টানাপড়েন। ফলে নির্বাচনের আগে জোট রাজনীতিতে আসছে নতুন সমীকরণ। যা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
নির্দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ে সব দল ও মতকে এক জায়গায় এনে রাজপথে বড় আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারবিরোধীরা। শিগগিরই সরকার পতন আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা দেবে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে মূলত দুই ভাগে বিভক্ত হবে জোট রাজনীতি। একদিকে থাকবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকারদলীয় জোট। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী আরেকটি জোট। ছোট ছোট দলগুলোও ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেবে। যাদের পাল্লা ভারী থাকবে তাদের সঙ্গেই জোট বাঁধবে। অন্য জোট হলেও কার্যত কিছুই হবে না।
সূত্র মতে— দীর্ঘ ১৭ বছর পর গত ২৪ সেপ্টেম্বর মহাজোট থেকে বেরিয়ে গেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশ (শরীফ নূরুল আম্বিয়া)। দলটির সঙ্গে বিএনপির সংলাপেরও সম্ভাবনা রয়েছে। আরেক মহাজোট সঙ্গী হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে গড়া জাতীয় পার্টিও (জাপা) এখন দুই ভাগে বিভক্ত। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি অংশ আওয়ামী লীগ সরকার সঙ্গে থাকতে একাত্ম প্রকাশ করছে।
আরেকটি গ্রুপ পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে মহাজোট ছাড়তে চাইছেন। যদিও জি এম কাদের জনসমক্ষে ঘোষণা দিয়েছেন তারা আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন জি এম কাদের সরকারবিরোধী জোটে যোগ দেবেন। এরই মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জি এম কাদের। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না গেলে বিনিময়ে রংপুর বিভাগের সব আসন দেয়া হবে জাতীয় পার্টিকে। দলের হেভিওয়েট নেতাদের নিজ নির্বাচনী এলাকার আসনও ছেড়ে দেবে বিএনপি। রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে ক্ষমতাসীনদের। মূলত পাওয়া না পাওয়ার হিসাব নিয়ে এই ক্ষোভ। গুঞ্জন রয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে মহাজোট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে কয়েকটি দল।
জানতে চাইলে শরীফ নূরুল আম্বিয়া নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘জাসদ গণতন্ত্র রক্ষার জন্য রাজনীতি করবে। এককভাবে চলবে। পাশাপাশি আমরা একটা ফ্রন্ট করতে চেষ্টা করব। আমরা গণতান্ত্রিক একটা জোটের সম্ভাবনা দেখি। সেভাবে আমরা কাউন্সিলিং করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির পক্ষে থেকে এখনো সংলাপের জন্য কোনো প্রস্তাবনা দেয়া হয়নি। যদি বিএনপি সংলাপের প্রস্তাব দেয় তাহলে আমাদের কমিটিতে আলাপ-আলোচনা করব, চিন্তা-ভাবনা করে দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
অন্যদিকে জামায়াত প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে ২০-দলীয় জোট ও বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সরকার পতনের বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকবে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যর পথেও বাধা ছিল জামায়াত। বিশেষ করে ডান-বাম-ইসলামী দলগুলো জামায়াত থাকায় জোটে যোগ দিতে চাইছিল না।
বিএনপির তৃণমূলসহ একটি অংশও খুশি। তবে কেউ কেউ বলছে— জামায়াত থাকলেও ঐক্য গড়তে কোনো সমস্যা হবে না। সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন চায়। সম্প্রতি এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি, গণতন্ত্র মঞ্চের অনুষ্ঠানে দেখা গেছে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল হালিমকে আসন ভাগাভাগি করতে।
বিএনপির সূত্রমতে, আগামী বছর মার্চে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু করবে বিএনপি। এরপর আন্দোলনে একে একে যোগ দেবে সমমনা বিরোধী দলগুলো। যারা যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকবে তাদের নিয়ে গঠন করা হবে বৃহত্তর ঐক্য। তারই অংশ হিসেবে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের জন্য সরকারবিরোধী দলগুলো ক্ষেত্র তৈরির কাজ শুরু করছে।
এমনকি সব দলের সমন্বয়ে আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের কাজ চলছে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আর এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ওই সময় জাতীয় ঐক্যের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। বিএনপি, সাতদলীয় গণতন্ত্রমঞ্চ ও অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা এরই মধ্যে ২০ দলীয় জোট ও জোটের বাইরে থাকা ২৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংলাপের সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি দলটি। আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) এবং জেবেল রহমান গানির বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) সংলাপ করার চেষ্টা করছে।
তবে মতপার্থক্য থাকলেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন ও ক্ষমতাসীনদের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারেও চলমান সংলাপে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হয়েছে।
গণতন্ত্রমঞ্চ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আন্দোলনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে সংলাপ শুরু করবে। যদিও গণতন্ত্র মঞ্চেও ফাটলের আশঙ্কা রয়েছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহামুদুর রহমান মান্না নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘সরকার লেজে-গোবরে হয়ে গেছে। তারা রাজনীতিতে ভাঙা-গড়ার খেলাসহ নানা ধরনের কৌশল নেবে। গণতন্ত্র মঞ্চ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। সরকারের কোনো কৌশলের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ যেন না পড়ে—সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে সবার।’
যুগপৎ আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপের পর আর কোনো আলোচনা আমাদের হয়নি। এখন আন্দোলনের সময়। কিন্তু তাদের কোনো উদ্যোগ নেই। এবার গণতন্ত্র মঞ্চ সংলাপ শুরু করবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। ওই সংলাপে বিএনপিকে ডাকা হবে। অচিরেই ফ্যাসিবাদী সরকার পতনে আন্দোলন শুরু হবে বলে জানান মান্না।
আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য বিএনপি সব দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে। সব দল বিএনপির কাছে তাদের নিজ নিজ প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে।
কিন্তু বিএনপি এখন পর্যন্ত আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। ফলে এ মুহূর্তে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন হচ্ছে না। তবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য শিগগিরই একমঞ্চ থেকে আন্দোলন শুরু হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘একটি কমন ইস্যু নিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এ ব্যাপারে প্রথম দফা আলোচনা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফা আলোচনা শুরু হবে। এজন্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অচিরেই সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে এক দফা অর্থাৎ সরকার পতন আন্দোলন শুরু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরশাদের শাসনামলে এবং ১/১১-তে দলের মহাসচিবকে দিয়ে বিএনপি ভাঙনের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় শেষ। বিএনপি জোটে সংযোজন হবে। আর আওয়ামী লীগের জোট ভাঙবে। অতীতেও দেখেছি, সরকারের শেষ সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক ঘটনা ঘটে। সরকার বিভিন্ন শক্তি দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকে। তবে এবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।’
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ