ঢাকা, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দালাল দৌরাত্ম্য অবিরাম

প্রকাশনার সময়: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:৪০

চলছে দরকষাকষি। ব্যাটে বলে মিলে গেলেই গ্রিন সিগন্যাল। এক হাত থেকে অন্য হাতে টাকা গেলেই ফাইলে বসে বিশেষ কোড কিংবা সাংকেতিক চিহ্ন। যা দেখে কাজের গতি বেড়ে যায়। চলে যায় নির্দিষ্ট কর্মকর্তার টেবিলে। আর এর সবই ঘটছে পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে গড়ে ওঠা দালাল চক্রের সিন্ডিকটে।

পাসপোর্ট অফিসগুলোতে এভাবেই নিয়মকে অনিয়মে পরিণত করা হয়। আর সব অনিয়মের যোগফল— ভোগান্তি। সাধারণ সেবাপ্রত্যাশীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগ করেন যাতনা।

রাজধানীর আগারগাঁও, উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট, নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট ও কেরানীগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ঘুরে অনিয়ম-দুর্নীতির এই চিত্র দেখা যায়।

একাধিক গ্রাহক বলছেন, বর্তমান ই-পাসপোর্ট চালু হলেও অনলাইনে আবেদন করে সঠিক সময় পাসপোর্ট মিলছে না। তাদের অভিযোগ অনলাইনে আবেদনের পর ছবি তোলা এবং আঙুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক) জন্য তারিখ মিলছে দেড় থেকে ২ মাস পর। যেখানে সাধারণ আবেদনের ক্ষেত্রে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা। যাদের জরুরিভিত্তিতে পাসপোর্ট প্রয়োজন তাদের একটি বড় অংশেরই এক প্রকার বাধ্য হয়েই দালাল চক্রের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।

মো. জামাল উদ্দিন নামের একজন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ২০ হাজার টাকা দিয়েছি একজন দালালকে। যাতে ২-৩ দিনের মধ্যে ৪৮ পাতার ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট পেয়ে যাই। এ বিষয়ে ওই দালালের সঙ্গে চুক্তিও হয় আমার। যদিও পাসপোর্ট করার সরকারি ফি সাড়ে ১০ হাজার টাকা।

পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বশীলরা বলছেন, দালাল মুক্ত করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে অভিযান চলে দালালদের ধরতে। তবে এখন আর দালাল নেই বললেই চলে। সেবাগ্রহীতাদের উদ্দেশ্যে তারা বলেন— দালাল ধরে নয় নিজেরাই এসে সেবা গ্রহণ করুন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন পাসপোর্ট, নতুন ই-পাসপোর্ট, এমআরপি পাসপোর্ট রিনিউ, নামের সংশোধন, পাসপোর্টের সঙ্গে ভোটার আইডি কার্ডের মিল, জরুরিভিত্তিতে ই-পাসপোর্ট প্রসেস ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেট নেয়ার জন্য সেবা গ্রহীতারা ভিড় করেন। এর জন্য দিনের পর দিন মাসের পর মাস নানা সমস্যা নিয়ে পাসপোর্ট অফিসের বারান্দায় ঘুরছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা দালাল সিন্ডিকেটের হাতে তারা জিম্মি।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আগে পাসপোর্ট অফিসে আশাপাশে দালালের দৌরাত্ম্য থাকলেও বর্তমানে তারা কৌশল পরিবর্তন করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে নতুন কৌশলে আস্তানা গেড়েছে আশপাশের ফটোকপির দোকানে। সেখানে বসেই টাকার বিনিময়ে চলে পাসপোর্ট করার কার্যক্রম।

নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে চোখ পড়ে একটি ফেসবুক পেজ। সেখানে লেখা— ‘আপনি কী পাসপোর্ট নিয়ে চিন্তিত? সহজেই আমরা আপনার পাসপোর্টসংক্রান্ত সব জটিলতার সমাধান করে দিতে পারব। পাসপোর্ট প্রসেস- যেমন, এক দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট জমা করানো, ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঝুলে থাকা ভেরিফিকেশন করে দেয়া, জরুরি ভিত্তিতে (৪-৫) কর্মদিবসের মধ্যে ই-পাসপোর্ট প্রসেস করা হয়।

পাসপোর্ট প্রসেস ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেট নেয়া, এছাড়াও ২-৩ মাসেও যারা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেট পাচ্ছেন এগুলো ২-৩ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট জমা করার ব্যবস্থা করে দেব। তাদের দেয়া নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে আগে টাকা পেমেন্ট করতে হবে বলে জানান। মূলত এগুলো শিক্ষিত দালাল সিন্ডিকেটের প্রতারণার ফাঁদ।

সরেজমিন, রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা। তখনও সব কর্মকর্তা আসেননি। এরই মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের ভেতর থেকে বাইরের রাস্তা পর্যন্ত সেবাপ্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন। পাসপোর্ট করার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নারী-পুরুষসহ লাইনে কমপক্ষে তিন-চারজন মানুষ। মূলত টোকেনের জন্যই পাসপোর্ট অফিসের সামনে এই দীর্ঘ লাইন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষের ভিড়। পাসপোর্ট অফিসের বিপরীত পাশে ফুটপাতে গড়ে উঠেছে ফটোকপির দোকান। আর সেখানে ঘাপটি মেরে বসে আছেন দালালচক্রের সদস্যরা।

মূলত এই দোকানের মালিকরাও দালাল চক্রের অন্যতম সদস্য। তাদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে অফিসের কর্মকর্তাদের। নাম-পরিচয় গোপন রেখে একটি ফটোকপির দোকানের পাশে অবস্থান নেয়া হয়। সেখানে এনআইডিসহ বিভিন্ন দরকারি কাগজপত্রের ফটোকপির কাজ চলছে। ফটোকপি করা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন একজন লোক। যার পরনে রয়েছে কালো প্যান্ট আর ছাই কালারের টি-শার্ট।

কথাবার্তায় ধারণা করা যায়, তিনি পূর্ব পরিচিত কেউ নন; পাসপোর্ট অফিসের দালালচক্রের সদস্য। সেই লোককে জাকির নামের এক দালাল বলছেন, আপনি চাইলে আপনার পাসপোর্ট দ্রুত করানো সম্ভব। বিনিময়ে আমাকে খুশি করলেই চলবে। তাছাড়া আপনি সহজে কোনোভাবেই পারবেন না। ভেতরে আমাদের লোক আছে। যদি রাজি থাকেন তাহলে আমাকে অর্ধেক টাকা দিয়ে যান আর কাজের টোকেন নিয়ে যান। কাজ সম্পন্ন করে আপনাকে ডাকা হবে। এভাবেই কাজ বাগিয়ে নেয় বাইরে ঘুরে বেড়ানো চক্র। এছাড়াও চা-দোকানে দেখা যায় দালালদের উৎপাত।

অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তিও পাসপোর্ট অফিসে দালালি করেন। তাদের কাছেও কাজ নিয়ে যান অনেক সেবাপ্রত্যাশী। সেবা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, দেশের কয়েকটি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যেখানে টাকা দিলেই দ্রুত সেবা মেলে। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আনসার থেকে শুরু করে কর্মকর্তা— টাকা ছাড়া বোঝে না কিছুই।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানী উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। দীর্ঘ ২-৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখা মেলে দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। অফিসের আশপাশে গড়ে ওঠা ফটোকপির দোকান। টাকার বিনিময়ে এদের হাতে দিলেই বের হয় পাসপোর্ট। দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলেই শুরু হয় নানা অজুহাত।

দালাল ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন করতে গেলে আবেদনকারীকে নানা অজুহাতে দালালদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য করা হয়। সাইদুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী নয়া শতাব্দীকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সার্ভার নষ্ট, ছবিতে সমস্যা, জন্ম তারিখে ভুলসহ নানা কারণ দেখিয়ে দালালদের কাছে যেতে বাধ্য করেন। আমরাও নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে তাদের কাছে ধরনা দিই।

নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দালাল চক্রের একটি তালিকা আসে। এদের মধ্যে, মায়ের দোয়া ফরিদ কম্পিউটার, আরাফাত কম্পিউটার বরকত জোমাদ্দার, সাইফুল এটুজেট কম্পিউটার, কামাল, রেজাউল, আলমগীর, হাসান কম্পিউটার, সাইফুল ইসলাম, মইউদ্দীন, মামুন, এম এম কম্পিউটার মুরাদ, আলফা কম্পিউটার, মাসুদ, ফারুক, মনির, রিপন, কামাল ও ইলিয়াস। মূলত এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলে উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম বলে একটি সূত্র জানিয়েছেন।

কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত ঢাকার যাত্রাবাড়ীর পাসপোর্ট অফিস। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও দালালদের দৌরাত্ম্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নয়া শতাব্দীকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা বসিরকে টাকা দিলেই এক দিনে মিলে যায় পাসপোর্ট এর ছবি তোলা ফিঙ্গার দেয়াসহ যাবতীয় কার্যক্রম, করে দেন ১ হাজার ৭৫০ টাকায়।

তিনি আরও বলেন, টাকা পাওয়ার পর পাসপোর্টের আবেদন ফরমের পেছনে একটি বিশেষ কোড দিয়ে দেন। আর সেই কোড দেখেই বাকি কার্যক্রম অতি সহজেই কর্মকর্তারা করে দেন।

অন্যদিকে, সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস গিয়ে দেখা যায়, এই কার্যালয়ে মূলত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার একটি অংশজুড়ে বসবাস করা মানুষ পাসপোর্ট করতে আসেন। প্রতিদিন সেবা নিতে আসে কয়েক হাজার মানুষ। সেখানে মার্কেটের নিচতলায় বেশ কয়েকটি ফটোকপির দোকান রয়েছে। আর এসব দোকান ঘিরেই দ্রুত পাসপোর্ট করার দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঘাপটি মেরে বসে থাকেন। সকাল থেকে সন্ধ্যাবধি বসেন চক্রের সদস্যরা।

গ্রাহকদের সঙ্গে বনিবনা হলেই গ্রাহককে পাঠানো হয় আনসারকর্মী রেজাউলের কাছে। দালাল টেলিফোনে গ্রাহকের নাম বলার পর অফিসের গেট থেকে নিয়ে গিয়ে বসায় নিচ তলায় ১০১ অথবা ১০২ নম্বর রুমে। আর সেখানেই সম্পন্ন করে অবৈধ কার্যক্রম। অর্থের বিনিময়ে কাজ করা ও দালাল সিন্ডিকেট সম্পর্কে জানতে চাইলে আনসার সদস্য রেজাউল প্রথমে অস্বীকার করেন। ভিডিও দেখানো হলে আর প্রশ্নের মুখে সটকে পড়েন।

পাসপোর্ট অফিসের এমন অনিয়ম এবং হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, দালালদের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ ধরনের অনিয়মের বিষয়ে আগে কখনও শুনিনি। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ