ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্থবির আবাসন খাত

প্রকাশনার সময়: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:১৬

গৃহ নির্মাণ কিংবা অবকাঠামোর সবধরনের কাজেই দরকার পড়ে রড ও সিমেন্ট। ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী রড ও সিমেন্টের বাজার। ৩ মাসের ব্যবধানে টনপ্রতি রডের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা।

সিমেন্টের দামও বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কিন্তু বৈশ্বিক নানা কারণে এই দুই নির্মাণ উপকরণের দাম এখন আকাশচুম্বী। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়, আবাসন খাত নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায়, স্থানীয় বাজারেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রড এবং সিমেন্ট। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচামাল আমদানিনির্ভর হওয়ায় বেড়েছে দাম। নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে সংকটে। রিহ্যাব বলছে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে আবাসন খাতে তৈরি হয়েছে স্থবিরতা।

রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বলেন, আবাসন খাতে বহুমুখী সংকটের মধ্যে নতুন সংকট নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি। পাশাপাশি বেড়েছে তেলের দাম। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের ব্যয়ও বাড়ছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী বলছেন, রড-সিমেন্ট সাধারণত ডলারে কেনা হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য দেশে এসবের দাম বেড়ে গেছে। এখন আমরা তো অসহায়। এসব কিছুর পেছনে আছে সিন্ডিকেট। তারা আমাদের যেভাবে নাচায় আমরা সেভাবে নাচি, নাচতে বাধ্য হই।

আগে ধরেন, প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৪৪০-৪৬০ টাকা। তারপর বিভিন্ন সময়ে দশ টাকা করে বাড়তে বাড়তে এখন সাড়ে পাঁচশ’র ওপরে চলে গেছে। মানভেদে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম প্রায় ৭০-৯০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে সংকটে পড়েছে অনেক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কাজ।

আবার ঠিকাদাররা বলছেন, যেভাবে দাম বাড়ছে এখনই যদি এর লাগাম টেনে না ধরা হয় তাহলে কাজ করা সম্ভব না। আমরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। আমরা নতুন করে কোনো কাজ ধরছি না। দাম বৃদ্ধির কারণে আমরা প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছি।

রড ও সিমেন্টের যৌক্তিক দাম খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন। আমদানিকারক ও উৎপাদকদের কাছে চিঠি দিয়ে ১১ ধরনের তথ্য জেনেছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব বলছে, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে আবাসন ব্যবসায় নেমে এসেছে স্থবিরতা।

জানা গেছে, দেশে বার্ষিক রডের চাহিদা প্রায় ৬০ লাখ টন। সিমেন্টের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। প্রয়োজনীয় এই দুই পণ্যের দাম শিগগিরই বেঁধে দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

রিহ্যাবের প্রথম সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, রড-সিমেন্টের দাম বাড়লে যে শুধু আবাসন খাতই সমস্যায় পড়বে তা নয়। বরং এটি দেশের যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজের জন্যই সমস্যার উদ্রেক করবে। দাম বৃদ্ধির কারণে রড-সিমেন্টের বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। আমরা যখন একটা প্রজেক্ট করি তখন আমাদের একটা বাজেট থাকে, যখন নির্মাণ খরচ আমাদের বাজেট অতিক্রম করে তখন আমরা কাজের গতি কমিয়ে দিতে বাধ্য হই।

সরকারি সংস্থা, টিসিবির বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে রডের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। মান ভেদে এক টন রডের বিক্রয় মূল্য ৯৩-৯৫ হাজার টাকা। যা গত তিন মাস আগেও বিক্রি হচ্ছিল ৮৬-৮৭ হাজার টাকায়। বাড়তির দিকে সিমেন্টের দামও। খুচরা পর্যায়ে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের বিক্রয় মূল্য ৫৫০-৬৬০ টাকা। দাম বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে।

উন্নয়ন প্রকল্পে জড়িতরা জানান, লকডাউনের পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে রডের দাম বেড়েছে। জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। প্রকল্পে অনেক মেশিন ডিজেলে চালাতে হয়। এতে খরচ বেড়ে গেছে। মূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে প্রকল্প ব্যয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। নতুবা প্রকল্প বাস্তবায়ন সঠিকভাবে করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম বেড়েছে। সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, কাঁচামালের দাম বাড়লেও অন্য খরচ কমিয়ে মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেশি বাড়লে সিমেন্টের দাম বাড়তে পারে। তারা বলছেন, ক্লিংকার তৈরির খরচ বাড়ায় রফতানিকারক পর্যায়ে যেমন দাম বাড়ছে, তেমনি জাহাজভাড়া বাড়ায় তা আমদানি মূল্যের সঙ্গে যোগ হচ্ছে।

সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালগুলোর সবই আমদানি করতে হয়। যার মধ্যে ৬২ শতাংশই হলো ক্লিংকার। গত অর্থবছরও দেশে ১ কোটি ৮৭ লাখ টন ক্লিংকার আমদানি হয়েছে। রাজধানীর এয়ারপোর্ট এলাকার একজন ডেভেলপার তাজুল ইসলাম কবির। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) কারণে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। করোনার প্রকোপ যখন কিছুটা কমলো তখন আমরা নির্মাণকাজ শুরু করলাম।

আর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই রড, ইট, বালু, পাথরসহ প্রায় সব উপকরণের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। আর নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে নির্মাণ খরচও বেড়ে যাচ্ছে। আগে প্রতি টন রড ৫২ হাজার টাকায় কেনা যেত। এখন তা প্রায় ৮২ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে।

অবকাঠামো উন্নয়নের প্রধান উপকরণের মধ্যে আছে রড, সিমেন্ট, পাথর ও ইট। এসব নির্মাণ উপকরণের সামনে চাহিদা বাড়বে। পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেল চালুর ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণ বঙ্গের ২১ জেলায় অবকাঠামো উন্নয়নে গতি বাড়বে। এতে অবকাঠামো নির্মাণের প্রধান উপকরণ রড ও সিমেন্টের চাহিদা বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সদস্যরা বলেছেন, একই কারণে আবাসন খাতের কাজে চরম বিঘ্ন ঘটছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের দামও বেড়েছে।

রিহ্যাব ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রথম) কামাল মাহমুদ বলেন, করোনার মহামারিকালে বড় ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছিল আবাসন শিল্প। করোনার প্রভাব কমার পর নতুন করে নির্মাণশিল্প উজ্জীবিত হয়ে উঠছিল। তবে দাম বাড়ার কারণে সেটা কতটা সম্ভব হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ফ্ল্যাটের টাইলস করছেন এমন একজন জানান, মাসখানেক আগেও প্রতি বর্গফুট টাইলসের যে দাম ছিল এখন তার চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। নির্মাণসামগ্রীর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটে আগের চেয়ে অন্তত ৫০০ টাকা ব্যয় বেড়েছে। নতুন ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে আগের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ