ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দুর্নীতির বরপুত্র তিনি!

প্রকাশনার সময়: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৪৫

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে পুরো দুই বছর চালিয়েছেন ঘুষের রামরাজত্ব, শিল্প-কারখানায় ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ। যেন তিনি দুর্নীতির এক বরপুত্র। আবারও তার চাকরিতে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে বলে উঠেছে গুঞ্জন। এই ‘তিনি’ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হারুনুর রশীদ মোল্লাহ।

অভিযোগে প্রকাশ, তিতাস এমডির চাকরির চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর খবর চাউর হওয়ার পর সংস্থাটির সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, তিতাস পরিচালনায় এমডির সততা যদি প্রশ্নবিদ্ধ না হতো এবং দক্ষতা দেখাতে পারতেন তাহলে হয়তো এতটা আপত্তি উঠত না। তিতাসের সেবার মান এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

সংস্থাটিতে অনিয়মটাই এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তারপরও কেন তাকেই নিয়োগ দিতে হবে। আর কি নিয়োগ পাওয়ার মতো যোগ্য কেউ নেই? নাকি তারা নিয়োগ কর্তাদের বিশেষ চাহিদা পূরণে অক্ষম! এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। গ্রাহকদের অভিযোগ— তিতাসের এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহ দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। ঘুষ না দিলে সেবা মিলছে না। অনেক সময় অন্যায় আবদার মেনে না নিলে নেমে এসেছে হয়রানির খড়গ। দেখা গেল সবকিছু ঠিক রয়েছে তবুও সিস্টেম আপগ্রেডেশনের নামে কোটি কোটি টাকার বিল চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

আয়মান টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারী লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাহাউদ্দিন মাহমুদ ইউসুফ বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, বলার ভাষা নেই। আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়া হয়েছে। তারা গ্যাস দিতে পারেনি কারখানা বন্ধ ছিল। অর্ডার সাপ্লাই দিতে পারিনি, নানামুখী সংকটে পড়েছি। বকেয়া বিল কিস্তি করে দেয়ার জন্য গেছি তারা নেয়নি। কোর্টে গেছি, কোর্ট কিস্তি করে দিয়েছে, তারপর টাকা দিতে গেছি তখনও নেয়নি। না নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য কী। এভাবে সাড়ে ৩ বছর ব্যবসা বন্ধ থাকার পর সংযোগ পেয়েছি। এতদিন বন্ধ থাকলে একটি বিনিয়োগের কী অবস্থা হতে পারে একবারও কি ভেবেছেন তারা। কতগুলো লোক বেকার হয়ে গেছে। ব্যাংক কি আমার সুদ মওকুফ করে দেবে?’

মাওনা এলাকার বদর স্পিনিং মিলসের অভিযোগটা আরও গুরুতর। তাদের কারখানার ইভিসি মিটারটিতে ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিতাস গ্যাসকে অবগত করে। তিতাস গ্যাস কোম্পানি সাড়া দেয় ৪ মাস পর জুনের ১৭ তারিখে। সেই মিটার পরীক্ষা করতে সময় লাগায় আরও ৬ মাস। পরে বিশাল অঙ্কের একটি গড় বিল পাঠিয়ে দেয় তিতাস গ্যাস। যার বিপরীতে বিইআরসিতে অভিযোগ দিয়েছে কোম্পানিটি।

শুনানিতে অংশ নিয়ে বিইআরসির সদস্য বজলুর রহমান কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে উপস্থিত তিতাস কর্মকর্তার কাছে। প্রায় কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারছিলেন না তিতাস কর্মকর্তা। মিটার পরীক্ষা করতে এত বেশি সময় লাগার আক্ষেপ প্রকাশ করে বজলুর রহমান বলেন, তিতাসে সেবা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই।

তিতাসের এমনি গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন, রাজধানীর শান্তা সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন। প্রতিষ্ঠানটির ইভিসি মিটারে বিল কমে এলে মালিকের পক্ষ থেকেই যাচাই করার আবেদন করা হয়। এরপর তিতাস মিটারটি খুলে নিয়ে যায়।

শান্তা সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনের মালিক মতিন খান বলেন, মিটারে সমস্যার কারণে খুলে নেয়া হলে ১৫ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হবে। মিটার যথাযথ না থাকলে ২০ দিনের মধ্যে রিপ্লেসমেন্ট করার নিয়ম রয়েছে। আমার মিটার খুলে নিয়ে যাওয়ার পর এক দিন তিতাসের লোক এসে হাজির। তারা আমার ফিলিং স্টেশনের প্রাচীর ভেঙে ফেলে। তারা মনে করেছিল লাইন বাইপাস থাকতে পারে, তাদের ধারণা মিথ্যা হয়ে যায়। তিতাসের পক্ষ থেকে সিস্টেম আপগ্রেডেশনের নামে ৭ কোটি ৬৪ লাখ ৬১ হাজার টাকার বিল প্রেরণ করা হয়। চিঠি প্রেরণের সময়েও জালিয়াতির আশ্রয় নেয় তিতাস। আমার হাতে কুরিয়ারে চিঠি আসে ১৮ তারিখে। ওই চিঠিতে বিল জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল ১৪ তারিখ। আর চিঠিটি কুরিয়ারে পোস্ট করা হয় ওই মাসের ১৫ তারিখে। অর্থাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের তারিখের পর চিঠি পোস্ট করা হয়। কয়েকদিন পর জানা গেল মিটার যথাযথ রয়েছে, তিতাসই সার্টিফাই করেছে।

তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে অবর্ণনীয়। তিতাসের লোকজন যা করেছে মাস্তানি ছাড়া আর কিছুর সঙ্গে তুলনা চলে না। আমি ধার-দেনা করেও বিল জমা দিয়েছি। কখনও বকেয়া হতে দেইনি। তারপরও ওই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।’

একজন শিল্পগ্রাহক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কারখানার উৎপাদিত শতভাগ পণ্য বিদেশে রফতানি করা হয়। কারখানা স্থানান্তর করে নতুন জায়গায় ১২ মিলিয়ন ডলারের আধুনিক মেশিনপত্র এনেছি। এক বছর আগে তিতাসে আবেদন করেছি সংযোগটি স্থানান্তরের। অনেকদিন ধরে ঘুরেও কোনো কূল-কিনারা করতে না পেরে দালাল ধরেছি। দালালকে ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে বসে আছি। মেশিন আনতে ১২ মিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ নিয়েছি। সেই ঋণের সুদ বাড়ছে আমার উভয় সংকটটা বুঝতে পারছেন কি? এসব কথা বলে তিতাসের মন গলাতে পারিনি। আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী এমন গ্যাঁড়াকলে পড়ে রয়েছেন। তিতাসের কারণে অনেকেই নিজের পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়ার পথে হাঁটছে।

শুধু সংযোগ বাণিজ্য নয়, তিতাসের আরেকটি বড় বাণিজ্যের জায়গা হচ্ছে গ্যাস চুরি। বাংলাদেশ বর্তমানে দৈনিক কম-বেশি ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে গত জুলাই-ডিসেম্বর সিস্টেম লস হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। দৈনিক সিস্টেম লসের পরিমাণ দেখানো হচ্ছে ২৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কারিগরি ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় গ্যাসের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস ধরা হয় সর্বোচ্চ ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান সম্প্রতি আবদুল জলিল গণশুনানিতে বলেছেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের ওপরে সিস্টেম লস নেই। সাড়ে ৮ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য নয়। এই মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।

অর্থাৎ প্রায় ৬ শতাংশ চুরিকে সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। দৈনিক চুরি যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চড়াদামে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ মাত্র ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট। স্পর্ট মার্কেটের এলএনজির মূল্যের (ঘনমিটার ৫০ টাকা আমদানি শুল্কসহ) সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক চুরি যাওয়া ৬ শতাংশ গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটিতে। যা বছরে ১ লাখ ৩ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার মতো। এই চুরির পরিমাণটি সরল অঙ্কের হিসেবে। আরেকটি অংক রয়েছে, আবাসিকের মিটারবিহীন ৩৪ লাখ গ্রাহক। মিটার বিহীন গ্রাহকরা মাসে ৪০ ঘনমিটারের নিচে ব্যবহার করলেও প্রতিমাসে ৭৮ ঘনমিটারের বিল দিয়ে এসেছে গত জুলাই পর্যন্ত।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে।’

তিতাসে একদিকে যখন সৎগ্রাহকদের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে তাদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন কেউ কেউ। তিতাসের এসব দুর্নীতি অনিয়ম অতীতের তুলনায় অনেকে বেড়েছে বর্তমান এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহের সময়ে। এমন একজন কর্মকর্তাকে আবার চুক্তিতে নিয়োগ দেয়ায় খবরে সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে বলে সংস্থার অনেকেরই দাবি।

এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহকে মোবাইলে ফোন দিলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ