তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড দিনে দিনে যেন অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকায় গ্যাস সরবরাহের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। তিতাসে গ্যাস-সংযোগে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। বছর বছর গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হলেও গ্রাহক সেবার মান যাচ্ছেতাই। আমলে নেয়া হয় না গ্রাহকদের গুরুতর সব অভিযোগও। এসব অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব
সম্প্রতি বাহ্বা নেয়ার জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার একটি খবর বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। গত ২৫ মে পাঠানো সেই বিজ্ঞপ্তিতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) গ্রামের নাম লেখা হয়। কিন্তু গ্রামবাসীর দাবি— তাদের এলাকায় কখনও লাইনই ছিল না। তাহলে কাটলো কীভাবে? এই ঘটনা জন্ম দিয়েছে হাস্যরসের। গণমাধ্যমকর্মীরা বলেছেন, তিতাস মাঝে-মধ্যেই বাহ্বা নেয়ার জন্য এমন উচ্ছেদ অভিযানের প্রেস রিলিজ পাঠায়। এতদিনও হয়ত অনেক কিছু বাগাড়ম্বর করেছে, এতদিন কেউ খোঁজ নেয়নি বলে ধরা পড়েনি।
আবার এমন ঘটনা ঘটেছে— গ্রাহকরা বিল জমা দিয়েছেন কিন্তু সেই বিল জমা হয়নি লেজারে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা গ্রাহকদের এসব টাকা মেরে দিয়েছেন। ঘটনাটি ধরা পড়ে বকেয়ার দায়ে লাইন কাটতে গেলে। গ্রাহক তখন তাদের জমা রশিদ দেখান। এই ঘটনাটি ধরা পড়েছে গত জানুয়ারি মাসের দিকে।
এভাবেই একের পর এক গ্যাস বিতরণের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের নতুন নতুন ও কল্পনাতীত অনিয়ম-দুর্নীতি উন্মোচিত হচ্ছে। অভিনব এসব দুর্নীতি একের পর এক জন্ম দিয়েই যাচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। অনিয়ম দুর্নীতিতে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি যেন অনন্য উদাহরণ। দুর্নীতির ইনোভেটিভ আইডিয়ার জন্য অ্যাওয়ার্ড থাকলে তিতাস গ্যাসই সবগুলো পেত বলে মন্তব্য করেছেন একজন সাবেক বোর্ড সদস্য।
রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি অভিনব ঘটনা ঘটে, গভীর রাতে সার্ভারে ঢুকে অবৈধ গ্রাহককে বৈধ করার। রাতের আঁধারে কোম্পানির সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করার অভিযোগে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে মামলা করে তিতাস। মামলায় অভিযুক্তরা হলো— উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রতন চন্দ্র দে, ব্যবস্থাপক রকিব উদ্দিন সরকার, উপ-ব্যবস্থাপক রজব আলি, রেজাউল করিম খান, উপসহকারী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন জাবেদ, সিনিয়র নিরাপত্তা প্রহরী মাসুদ রানা, আবুল কালাম আজাদ ও মাকসুদুল হক। প্রাথমিকভাবে এক রাতেই ১ হাজার ২৪৭টি সংযোগ বৈধ করে দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানায় ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর একটি মামলা দায়ের করা হয়। তিতাস সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ ধরনের অন্তত ৭ লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে তিতাসের সার্ভারে।
জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১২ সালে আবার সংযোগ চালু হলেও ২০১৩ সালের শুরুতেই তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সরকারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই প্রতিবছর সংযোগের তথ্য উঠে এসেছে তাদেরই বার্ষিক প্রতিবেদনে। অনেকে মনে করেন, তিতাসের প্রতিবেদনে সামান্যই উঠে এসেছে। এর চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে অবৈধ সংযোগ। যেগুলো ঘুষের বিনিময়ে সংযোগ দেয়া হয়েছে, আর প্রতিমাসেই সেসব গ্রাহক থেকে একটি মহল সরাসরি বিল আদায় করছে। সূত্র মতে, ২০১৮ সালের প্রথম দিকে তিতাসের বোর্ড সভা সাত লাখ গ্রাহকের সংযোগ বৈধ করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তিতাসের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ছিল ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯, যা ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ছিল ১৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৫৩। অর্থাৎ চার বছরে সংযোগ বেড়েছে ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানিটির দুর্নীতির বিষয়ে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) একটি সার্বিক অনুসন্ধান পরিচালনা করে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে তিতাসের দুর্নীতির ২২টি খাত চিহ্নিত করে, ১২ দফা সুপারিশ প্রদান করে। এতে বলা হয় অবৈধ চুলার জন্য বৈধ চুলার সমান টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করার তথ্যও পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিনজিরা, ফতুল্লা, সোনারগাঁও, নরসিংদী ও গাজীপুর এলাকায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৪৫৫টি অবৈধ চুলা বা সংযোগ চিহ্নিত করা হয়। প্রতি মাসে প্রতি চুলা বাবদ ৬৫০ টাকা হারে ওই গ্যাসের দাম হয় ৯২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। কিন্তু উক্ত অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্ন না করায় ওই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে মর্মে দুদক মনে করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাসের এক কর্মচারী জানান, তিতাস অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রাহক পর্যায়ে অনুমোদনের কম-বেশি গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু সরবরাহের পরিমাপ করার জন্য ইভিসি (ইলেকট্রনিক ভলিউম কারেক্টর) করে না। ওই মিটারের মাধ্যমে প্রবাহিত গ্যাসের তাপ ও চাপসংক্রান্ত তথ্যাদি সার্বক্ষণিকভাবে রেকর্ড হয়। এতে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সঠিক হিসাব আসে। কিন্তু তিতাসের কর্মীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ইভিসি বসান না অথবা ইচ্ছা করেই গরমিল করেন। তিতাসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে অর্থের বিনিময়ে শিল্প এলাকায় পোস্টিং নিয়ে আছেন, যার কারণে এরা খুব সহজেই সিন্ডিকেট গড়ে দুর্নীতি করেন।
২০১৫-১৬ অর্থবছরের অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দুদক দেখেছে, ওই বছর আবাসিক খাতে অনুমিত প্রবাহ ছিল ১০ হাজার ৩১৭ কোটি ৬৯ লাখ ৩৫ হাজার ৫৬৮ ঘনফুট। কিন্তু ব্যবহার হয়েছে ৮ হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৪ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৯ ঘনফুট। অনুমিত সরবরাহ থেকে ১ হাজার ৪৭৭ কোটি ৯৪ লাখ ৩৮ হাজার ৬৬৯ ঘনফুট গ্যাস কম ব্যবহার হয়েছে, যার মূল্য ২৯২ কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯২১ টাকা। তারপরও সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে। অনুসন্ধানে দুদক জেনেছে, বিভিন্ন শিল্পকারখানায় অবৈধ সংযোগ বা বাইপাস করে তা গৃহস্থালিতে সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হয়।
রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুরে গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। আবাসিক গ্রাহক রয়েছে ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৮ জন, বাণিজ্যিক গ্রাহক সংখ্যা ১২ হাজার ৭৫টি, সিএনজি ৩৯৬টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১ হাজার ৭০১টি, শিল্পগ্রাহক রয়েছে ৫ হাজার ৩১৩ এবং ৩টি সার কারখানা ও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করছে।
তবে জনশ্রুতি রয়েছে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ) মেয়াদকালে কিছুটা সুনাম ছিল। তিনি তিতাসে কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করেছেন বলে অনেকের দাবি।
আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ বলেন, তিতাসে এত অবৈধ সংযোগ রয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সার্ভারে অবৈধ গ্রাহকদের বৈধ করা প্রসঙ্গে বলেন, যারা দুর্নীতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আমি জানি।
তিনি বলেন, সকল অফিসারের জন্য তিতাসের সার্ভার উন্মুক্ত ছিল কিন্তু আমার আমলে নিয়ম করে দিয়েছি মাত্র দুইজনের অ্যাক্সেস থাকবে এবং এমডি’র অনুমতি নিয়ে তবেই পোস্টিং দিতে পারবে। ২০১২ সালে অবৈধ গ্রাহকদের জমাকৃত ১০০ কোটি টাকার বিষয়ে তার জানা নেই বলে জানান তিনি।
তিতাসের সাবেক এই এমডি বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে আমি কখনওই কাউকে ছাড় দেইনি। আপনারা দেখেছেন করোনার মধ্যেও আমরা অনেক অভিযান পরিচালনা করেছি। আশা করি তিতাসে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
নয়া শতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ