ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কষ্টের নীল আগস্ট

প্রকাশনার সময়: ০৯ আগস্ট ২০২১, ০১:৩৪

আগস্টকে কেবল শোক বা জাতীয় শোকের মধ্যে রাখলে কম হয়ে যায়। মাসটি এর চেয়েও বেশি। তাই বলে মাস দায়ী নয়। দায়ী হায়েনারা। বেদনা কেবল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডিতে নয়। বিভিন্ন বছরের এ মাসটিতে ঘটেছে শোক-বেদনার নানা ঘটনা। কমণ্ডবেশি নীল বেদনাবিধুর ঘটনা প্রতি মাসেই রয়েছে। কিন্তু আগস্ট বেদনায় ঠাসা বলে মাসটি আতঙ্কের। কষ্ট-লজ্জার। কলঙ্কের-জঘন্যেরও।

বাঙালিকে সেই অভিশাপের ইতিহাসটা তাড়া করছে বারবার। ষড়যন্ত্রটা পুরনো পাতার কাহিনী। আগস্টই যেন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশ যেন কেঁপে ওঠে। ইতিহাস যেন ভীতিকর অবস্থায় পড়ে যায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘাতকদের বুলেট বঙ্গবন্ধু স্বজনদের কেউ রেহাই পায়নি। তৈরি হয় নারী-শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার কুনজির। ধানমন্ডি ‘বত্রিশ নম্বরে’ অকল্পনীয় নির্মমতায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধু অনুজ শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রাসেল এবং কামাল-জামালের নববিবাহিত স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। শিশু রাসেলের বেঁচে থাকার আকুতিও ঘাতকদের মন গলাতে পারেনি। বিদেশে থাকায় প্রাণে বাঁচেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

৩২ নম্বরের অদূরে থাকা বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাদ, তার পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী আরজুকেও হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্টের এই বর্বরতা শুধু কয়েকজন বিপদগামী উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তার দলবদ্ধ আস্ফালন মনে করা যায় না। এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা সেদিনও উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জল্লাদের ভূমিকা পালনকারী ফারুক-বজলুল হুদাদের মৃত্যু কার্যকর হয়েছে আইনি প্রক্রিয়ায়। কয়েক খুনি এখনো বিদেশে পলাতক।

কলঙ্কিত আগস্টের আরেক ঘটনা ২০০৪ সালে। ওই বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ঘটানো হয় গ্রেনেড হামলা। শেখ হাসিনা প্রাণে বাঁচলেও নিহত হন ২৪ জন। সেদিন মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরো ১২ জন নিহত হন। হাসপাতালে নিহত হওয়া সেই ১২ জনের একজন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান। রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী। ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

যাবজ্জীবন দেয়া হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে। এর পরের বছর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট আরেক কলঙ্ক। সেদিন ঢাকাসহ দেশের ৩০০টি স্থানে ৫০০ বোমা হামলা করা হয়। আধ ঘণ্টার ব্যবধানে চালানো এ সিরিজ বোমা হামলায় দু’জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। ৬৪ জেলার মধ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলা বাদে অবশিষ্ট ৬৩টি জেলায় এই হামলা করা হয়। হামলার জায়গাগুলোতে জেএমবির জঙ্গিরা লিফলেট ছড়িয়ে দেয়। ওইদিন সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সময়ে ৬৩ জেলার প্রেসক্লাব, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ঢাকার ৩৪টিসহ সাড়ে ৪শ’ স্পটে প্রায় ৫শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি।

এই মাসটিতে বিয়োগান্তক আরো ঘটনা রয়েছে। আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয় এই মাসেই। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তার প্রয়াণ দিবস। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যও হয় আগস্টেই (১৯৭৬)। আধুনিক কবি শামসুর রাহমানকেও হারিয়েছি আগস্টে। এ মাসেই হারানোর তালিকায় আছেন আমাদের নাট্য জগতের দুই দিকপাল আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সেলিম আল দীন। তারেক মাসুদণ্ড মিশুক মুনিরও।

অকুতোভয় বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসিও এ মাসে (১১ আগস্ট)। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় নেতাজী সুভাষ বসুকে বহনকারী বিমান তাইপেতে দুর্ঘটনার শিকার হলে। এতে ভারতের বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষ বসুর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়। নেতাজীর মৃত্যুর অল্প কছেশ দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে অসংখ্য বোমা নিক্ষেপ করে হাজার হাজার জাপানির মৃত্যু ঘটায়। আগস্ট মাসের এ ঘটনা জাপানিদের কাছে ভয়াবহ স্মৃতির ইতিহাস। ২০ আগস্ট বাঙালি হারিয়েছে তার অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে।

১৯৯৫ সালের আগস্টেই দিনাজপুরে একদল পুলিশ সদস্য ধর্ষণের পর হত্যা করে তরুণী ইয়াসমিনকে। এবারসহ গত দুটি আগস্ট টানা করোনা নামের অদৃশ্য মহামারির ধকল। প্রতিদিন শত শত মৃত্যু। কায়োমনো বাক্যে আরাধনা আগামীসহ আগস্টগুলো যেন তার অপয়া কলঙ্ক থেকে মুক্তি পায়। শোকের তালিকা যেন আর দীর্ঘ না হয়। হায়েনাদের অট্টহাসির দিন শেষ হোক। আগস্ট হোক কালিমামুক্ত। বাঙালি হোক দায়মুক্ত। শোকের সঙ্গে আগস্ট বড় আবেগেরও। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডিতে নিহত বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসার জন্ম এই আগস্টেই ১৯৩০ সালে। সেই কালো রাতে হত্যা করা বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালেরও জন্ম আগস্টে। ১৯৪৫ সালের ৫ আগস্ট জন্ম তার। বেদনার সঙ্গে আবেগের কী সম্মিলন!

কবি হেলাল হাফিজের ‘ফেরীঅলা’ কবিতা আগস্টে বড় প্রাসঙ্গিক লাগছে। কবিতাটিতে চোখ না বুলিয়ে কি পারা যায়?

কষ্ট নেবে কষ্ট/হরেক রকম কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট!/লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট/পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট/আলোর মাঝে কালোর কষ্ট/‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট।/ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট

দাঁড়ির কষ্ট/চোখের বুকের নখের কষ্ট/একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট/প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট/অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট/ভুল রমণী ভালোবাসার/ভুল নেতাদের জনসভার/হাইড্রোজনে দুটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট/দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট/পথের এবং পায়ের কষ্ট/অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরিঅলার কষ্ট/কষ্ট নেবে কষ্ট/আর কে দেবে আমি ছাড়া/আসল শোভন কষ্ট/কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন/আমার মতো ক’জনের আর/সব হয়েছে নষ্ট/আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ