টাকা দিলেই পাস, না দিলেই ফেল। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে যেন এমনটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে (বিআরটিএ)। সেবাগ্রহীতাদের জিম্মি করে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এ জন্য তারা বিআরটিএ অফিসের আশপাশে ফটোকপি, টং দোকান ও খাবার হোটেলকে বানিয়েছেন নিজস্ব অফিস।
ড্রাইভিং লাইসেন্স, নাম ট্র্যান্সফার, লাইসেন্স নবায়ন, ফিটনেস সার্টিফিকেট তৈরি, ভেরিফিকেশন রিপোর্ট ও ডোপ টেস্ট রিপোর্টের সমাধান মেলে দালালদের অফিসেই। ফাইলে দেয়া হয় বিশেষ মার্ক (নম্বর) আর এ মার্ক দেখেই কর্মকর্তারা স্বাক্ষর করেন ফাইলে। মিরপুর ও দিয়াবাড়ি বিআরটিএ কার্যালয়কে ঘিরে চলছে এমনই তুঘলকি কারবার।
জানতে চাইলে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, এর আগেও বিআরটিএতে অভিযান পরিচালনা করেছিলাম সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও ভোগান্তি দেখে। তখন দালাল চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছিলাম। তদন্তে দেখেছিলাম অনিয়মের কাজে জড়িত ছিল অন্তত ১৪২টি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল। যোগসাজশের সুযোগ নিয়ে খুব সহজেই অপরাধীচক্র পেয়ে যান লাইসেন্স।
তিনি বলেন, এখন আবারও যদি সঠিক তথ্য-প্রমাণ পাই তবে আমরা অভিযান পরিচালনা করবো। বিআরটিএর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কিনা প্রশ্নে ডিবির এই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি একটি অভিযানে গ্রেফতার দালালদের থেকে কয়েকজন কর্মকর্তার নাম আমরা পেয়েছি। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি বিআরটিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হয়েছিল।আলিফ হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী নয়া শতাব্দীকে বলেন, টাকা আর তদবির ছাড়া কোনও কাজ করানো যায় না দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসে। চক্রের কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোর বদনাম হচ্ছে। আলিফের কথার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে নয়া শতাব্দী। এরপর বেরিয়ে আসে দিয়াবাড়ি ও মিরপুর কার্যালয়ে বিআরটিএ’র কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় গড়ে ওঠা দালাল সিন্ডিকেটের নাম। যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় এই কথিত বুথ।
লাইসেন্স করতে আসা সাব্বির নামের এক গ্রাহক নয়া শতাব্দীকে জানান, দালাল ছাড়া এখানে ফাইল নড়ে না। অনেক সময় টাকা দিয়েও দালালদের পেছনে ঘুরতে হয় দিনের পর দিন। ফাইলের মধ্যে একটি বিশেষ মার্ক থাকে, যা দেখলে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন ফাইলটি কোন দালালের।
পরিচয় গোপন রেখে দিয়াবাড়ি বিআরটিএ’র সামনে একটি চা দোকানে বসে জানা যায়, দালাল চক্রের সদস্যদের সম্পর্কে। এক ঘণ্টায় ওই চা দোকানে প্রায় ১০-১৫ জনের কাছ থেকে কাগজপত্র নেন ৪ জন ব্যক্তি। খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেল তাদের নাম- সফুর উদ্দিন, বাবু, মানিক ও ফারুক। কাগজপত্র নিয়ে তারা সরাসরি প্রবেশ করেন কার্যালয়ে।
উত্তরার ৫নং সেক্টরের বাসিন্দা মোজাম্মেল হক জানান, তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে এসেছেন। কিন্তু কঠিন পরীক্ষায় তার পক্ষে পাস করা সম্ভব নয়। সেজন্য বন্ধুর মাধ্যমে ১৫ হাজার টাকায় ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে কাগজপত্র তুলে দিয়েছেন দালালের হাতে। এর মধ্যস্থতা করেন চা দোকানদার।
দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জানতে সরাসরি দিয়াবাড়ি কার্যালয়ে গিয়ে না পেয়ে তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া সরকারি মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার কল করেও মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন ও মালিকানা বদলি শাখার সহকারি পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শহিদুল আজম ও ড্রাইভিং শাখার সহকারি পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মাহফুজুর রশিদের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অবৈধ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে দিয়াবাড়ি বিআরটিএ কার্যালয়ে দালালি করেন এমন একজন দোকানদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, “ভাই কী করবেন? দরকার নেই নিউজ করার। আসেন আপনাকেও মাসে টাকার ব্যবস্থা করে দিই। এসব টং দোকান দিয়ে সংসার চলে না। তাই স্যারদের সহযোগিতায় দালালি করে কিছু টাকা কামাই।”
বিআরটিএর একটি সূত্র জানায়, করোনার পর থেকে বিআরটিএর কাজের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বহু গুণ বেড়ে গেছে। প্রতিদিন শত শত গাড়ি ফিটনেস হালনাগাদ এবং লাইসেন্স নবায়নের জন্য ভিড় করছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। এতে চরমভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন বিআরটিএ’র কর্মকর্তারাও।
সরেজমিনে মিরপুর ও দিয়াবাড়ি বিআরটিএ কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের পেছনের গলির রোডে দুই পাশে বেশ কয়েকটি ফটোকপি, খাবার হোটেল ও চা দোকান রয়েছে। সেখানে চলে বিআরটিএর জন্য প্রয়োজনীয় ফটোকপির কার্যক্রম। সেখানে ফিটনেস সার্টিফিকেট তৈরি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লাইসেন্স নবায়ন, নাম ট্র্যান্সফার করে দেয়ার নামে প্রতারণা করছে একটি চক্র।
রাকিব নামের একজন সেবাগ্রহীতা নয়া শতাব্দীকে জানান, বাইকের নাম ট্র্যান্সফার করতে এসেছেন। যেখানে ১৫০ সিসি বাইকের জন্য প্রয়োজন ৬ হাজার টাকা, দালালরা সেখানে নানা জটিলতা দেখিয়ে নিলেন ৮ হাজার টাকা। উনি (দালাল) কি আপনার পূর্বপরিচিত— এমন প্রশ্নে রাকিব বলেন, না। এখানে এসে পরিচয়। তিনি এসে বললেন, আমরা নিজে যদি কাজ করাই কয়েক দিন ঘুরতে হবে। তাকে টাকা দিলে কয়েক ঘণ্টায় করে দেবেন। সেজন্য দিলাম। কাজও হয়ে গেল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরপুর মাজার রোড ও বিআরটিএ পাশের গলিতে কয়েকজন দালাল মিলে ‘বিকল্প’ বিআরটিএ অফিস খুলে বসেছে। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর জামিনে বের হয়ে ফের একই কাজে লিপ্ত তারা। এই কথিত অফিস নিয়ন্ত্রণ করে— মোহাম্মদ আলী ওরফে মিস্টার, লিটন পাইক, আবদুল্লাহ রনি, সুজন পাইক, হাসান শেখ ওরফে আকচান, হুমায়ুন কবিরসহ ১০-১২ জন সহযোগী।
নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে দালাল চক্রের একটি তালিকাও। যারা নিয়মকে অনিয়মে পরিণত করে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। মিরপুর বিআরটিএ দালাল চক্র নিয়ন্ত্রণ করে যারা— রাফি হাওলাদার, জাকির হোসেন, অভিজিৎ মণ্ডল, হাফিজুর রহমান, মারুফ বিল্লাহ, কবির, সোহেল মিয়া, ইমরান, শিপন, সুজন মিয়া, উজ্জ্বল হোসেন, ইসমাঈল, খাইরুল ইসলাম, খোকন মোল্লাসহ কয়েকজন।
রাসেল মাহামুদ নামের এক ভুক্তভোগী নয়া শতাব্দীকে জানায়, আমি নিজেও ভুক্তভোগী, টাকা দিলে লাইসেন্স, না দিলে তারা কথাই বলে না। যেন এটা তাদের বাপ-দাদার প্রতিষ্ঠান। অথচ এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনও মাথাব্যথা নেই।
ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দালালরা জাল ভেরিফিকেশন রিপোর্ট ও ডোপ টেস্টের জাল সনদ তৈরির আবেদনপত্র দিয়াবাড়ি বিআরটিএ কার্যালয়ে তাদের কমিশনভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে জমা দিতেন। ওই সনদে পুলিশ কর্মকর্তার যে বিপি নম্বর উল্লেখ করা হয়, তা ভুয়া। এসব জেনেশুনে দিয়াবাড়ি কার্যালয়ের বিআরটিএর এক শ্রেণির কর্মকর্তারা এ আবেদন গ্রহণ করতেন। তারা আবেদনকারীকে লিখিত, মৌখিক ও মাঠে যান চালানোর পরীক্ষায় টাকার বিনিময়ে পাশ করিয়ে দিতেন। এতে কয়েকজন বিআরটিএ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম উঠে এসেছে বলেও জানান।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ