ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ওষুধের দামে বড় লাফ

প্রকাশনার সময়: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:২৭

প্রথমে করোনার আঘাত। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ দুইয়ের প্রভাবে অস্থির বিশ্বের জ্বালানি ও ডলার বাজার। দেশে দেশে বেড়েই চলছে মূল্যস্ফীতি। বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। করোনা ও যুদ্ধের অজুহাতে দাম বেড়ে যায় দেশের প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে সরকার। যার প্রভাবে আরেক দফা দাম বাড়ে নিত্যপণ্যের। এবার দাম বাড়ার ধারায় যুক্ত হয়েছে ওষুধ।

অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপ ও প্রেসারের ওষুধের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও বহুল ব্যবহূত ৫৩টি ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় শতভাগ। যা বিগত তিন মাসের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ। এত বড় ব্যবধানে ওষুধের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো, কাঁচামালের খরচ বৃদ্ধিসহ পরিবহন ও বিপণন ব্যয় বৃদ্ধিতেই ওষুধের বাজারের প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

অবশ্য বিশেষজ্ঞদের দাবি, এভাবে ওষুধের দাম বাড়লে দেশের চিকিৎসা খাত বড় সংকটে পড়বে। কারণ মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের বড় অংশই ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর কাছেও অনেকটাই অসহায় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। ফলে কোম্পানিগুলোর উচ্চাভিলাষী বিপণন নীতি ও অধিক মুনাফার প্রবণতায় মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর কোম্পানিগুলোর অতি মুনাফা প্রবণতার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

সাধারণ মানুষ বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে কম ব্যবহার করে আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়। তবে ওষুধে সে উপায়ও নেই। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ কিনতেই হয়। বিকল্প কোনো উপায় নেই ওষুধসেবীদের সামনে। দাম বাড়ায় আয়ের একটি বড় অংশই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ওষুধের পেছনে।

রাজধানীর বাসিন্দা নাতাশা শিকদার। বৃদ্ধ বাবা-মা ও দুই শিশু নিয়ে তাদের ৬ সদস্যর পরিবার। শিশু এবং প্রবীণ- দুই বয়সের মানুষের জন্য প্রতিমাসে ওষুধ বাবদ তার খরচ তিন-চার হাজার টাকা। এখন বাড়তি আরো দুই থেকে তিন হাজার টাকা লাগছে। নাতাশা বলেন, তার সন্তানের প্রায়শই ঠান্ডা জ্বর লেগে থাকে। অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে হূদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিক সমম্যায় ভুগছেন তার বাবা-মা। এজন্য এ ধরনের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়মিত কিনতেই হয়। বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি ওষুধ কিনতেও রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, আমার বাচ্চার ওষুধ যদি দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা হয়ে যায়, বাবার ওষুধের দাম যদি তিন থেকে ছয় হাজার টাকা হয়, তাহলে আমরা সারা মাস চলব কীভাবে? আমাদের রোজগারই বা কতোটুকু। ওষুধ বাদ দিলে তো হাসপাতালে দৌড়তে হবে। সেই অবস্থাও তো নেই। ওষুধ তো বাদ দেয়া সম্ভব না।

রাজধানীর কাকরাইল মোড়ের লার্জ ফার্মা ওষুধের এক কর্মচারি জানান, দু’মাস আগেও নাকের ড্রপ এন্টাজলের দাম ছিলো ১৩৮ টাকা, এখন ২৪০ টাকা। শিশুদের যে নাপা সিরাপ ছিল ২০ টাকা, এখন ৩৮ টাকা। এন্টোবায়োটিক ক্যাপসুল জাই ম্যাক্সের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ। ৩০ টাকার প্রতি ক্যাপসুলের দাম হয়েছে ৫৫ টাকা। এভাবে দাম বেড়েছে প্রায় ৫৩ ধরণের জরুরি ওষুধের। অতি প্রয়োজনীয় এসব ওষুধের দাম গত দেড় মাসে বেড়েছে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ।

তিনি আরো জানান, গত এপ্রিল থেকে প্রতি মাসেই বেড়েছে ওষুধের দাম। প্রায় সব কোম্পানিই দাম বাড়িয়েছে। জানা যায়, গত জুলাই মাসে বহুল ব্যবহূত ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। কিন্তু চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই দাম বাড়িয়েছে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো। এছাড়াও ওষুধ কোম্পানিগুলো আরো বেশকিছু ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও ইতিমধ্যে জমা দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৫৩টি ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপ বা প্রেসারের ওষুধের দাম। একই সঙ্গে প্যারাসিটামল, হূদরোগ, ব্যাথানাশক ও পেটে গ্যাসের সমস্যার নিয়মিত ওষুধের দামও বেড়েছে ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ কিছু ওষুধের দাম দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে ডলার বাজারে অস্থিরতা আর জ্বালানির দাম বেড়ে চলা- এই তিন কারণ বেড়েছে ওষুধের দাম। এছাড়াও প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণেই বেড়ে চলেছে ওষুধ উৎপাদনের খরচ।

এ বিষয়ে ওষুধ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মুক্তাদির বলেন, গত মাসে ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল ৮০ টাকা ডলারে। শিপমেন্ট পৌঁছানোর পর ডলারের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। প্রতি ডলারে ৩০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। এছাড়া মোড়ক, পরিবহন, বিপণন ব্যয় বাড়ার প্রভাবও ওষুধের বাজারে দেখা যাচ্ছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় দেড় হাজার জেনেরিকের (শ্রেণিগত বা জাতীয়) ৩৫ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি হয়। এগুলোর মধ্যে কেবল ১১৭টি ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর বাইরে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে কোম্পানিগুলো। গত জুলাই মাসে ৫৩ ধরনের ওষুধের দাম বাড়াতে উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু সেই আবেদন চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই বাজারে দাম বাড়ানো হয়েছে।

জানতে চাইলে ওষুধ অধিদফতরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামাল, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়সহ নানা কারণে ওষুধের খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ওষুধের দাম আচমকা বাড়ানো হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। প্রাইজ পলিসি অনুযায়ী অনেকদিন ধরে দাম আপডেট করা হয়নি। আরো কিছু ওষুধের দামবৃদ্ধির আবেদন আছে। সেগুলো যাচাই বাছাই করে, যৌক্তিক মনে হলেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও জানান এই পরিচালক।

ওষুধে এই বাড়তি দাম রোগীর ওপরে চাপ আরো বাড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক নাহিদ আক্তার জাহান। তিনি বলেন, জীবনরক্ষাকারী ওষুধগুলোর দাম প্রাইভেট মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেয়া যাবে না। এই দামের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এজন্য সরকার অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে, যেন এর বেশি দামে কেউ বিক্রি করতে না পারে। অথবা সরকার নিজেই উৎপাদন করে অল্প দামে ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করতে পারে।

জানতে চাইলে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ওষুধ বাবদ খরচ হয়। এবং এই খরচ পুরোটায় যায় রোগীর পকেট থেকে। অর্থাৎ দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওষুধেই মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। ওষুধের দাম নাগালের বাইরে চলে গেলে তখন চিকিৎসা খাতও নিম্নবিত্ত মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে। যার সার্বিক প্রভাব পড়বে জনস্বাস্থ্যের ওপর।

তিনি আরো বলেন, সরকারের নজরদারির অভাব ও আইনি দুর্বলতার কারণেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ওষুধের দাম।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ