সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে যেন লুকোচুরির শেষ নেই। আজ কমছে তো কাল বাড়ছে—একেবারে বানরের তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কের মতো। তবে দিনশেষে এই খেলায় জয়ী ব্যবসায়ীরাই। দাম বৃদ্ধির গতি এতটাই ঊর্ধ্বমুখী, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে এই পণ্যটি। গতকাল মঙ্গলবার আবারো বাড়ল কেজিতে ৭ টাকা। এখন থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৯২ টাকায় বিক্রি হবে। ২০২২ সালেই ৭ দফায় পরিবর্তন করা হয়েছে মূল্য। ক্রেতারা বলছেন, আবারো তেলের দাম বাড়ছে। একবার কখন বাড়ে আর কখন কমে— এটা বোঝাই বড় কঠিন। বৃদ্ধি-কমার এই খেলায় বৃদ্ধি বড় ব্যবধানে জয়ী। ১৯২ টাকায় তেলের কেজি কেনা—আমাদের জন্য বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। গতকাল থেকে সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা জানিয়েছে মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
এর আগে ডলারের দর বাড়ার কারণে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল মিল-মালিকদের এই সংগঠন। দাম বাড়ানোর এ প্রস্তাব ৩ আগস্ট বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) দিয়েছে সংগঠনটি। প্রস্তাবে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮০ টাকা, এক লিটারের বোতল ২০৫ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯৬০ টাকা করার কথা বলা হয়েছিল। মিল মালিকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৭৫ টাকায়, যা এর আগে ১৬৬ টাকা নির্ধারিত ছিল। অর্থাৎ, খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে বাড়ছে ৯ টাকা।
প্রতি লিটার বোতলের সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৯২ টাকায়, যা এতদিন ১৮৫ টাকা ছিল। অর্থাৎ লিটার বোতলে ক্রেতাকে ৭ টাকা করে বাড়তি গুনতে হবে।
সয়াবিন তেলের ৫ লিটারের বোতল বিক্রি হবে ৯৪৫ টাকায়। সেক্ষেত্রে লিটার প্রতি দাম পড়বে ১৮৯ টাকা। নতুন সিদ্ধান্তে সয়াবিনের দাম বাড়লেও লিটারে ৭ টাকা কমেছে পাম তেলের দাম। প্রতি লিটার পাম তেল এখন বিক্রি হবে ১৪৫ টাকায়, যা আগে ১৫২ টাকা নির্ধারিত ছিল।
এ বছর বোতলজাত সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ প্রতি লিটার ২০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, যা সম্প্রতি দুই দফায় ২০ টাকা কমিয়েছে তেল কোম্পানিগুলো।
এর মধ্যে সর্বশেষ গত ২১ জুলাই লিটারপ্রতি দর ১৪ টাকা কমানো হয়। অবশ্য বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এখন বলছে, টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ভোজ্যতেলের আমদানিমূল্য বেড়েছে। এ কারণে দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, এক বছর আগেও বোতলজাত তেলের লিটার ছিল ১৩৪ টাকা করে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তা নির্ধারণ করা হয় ১৬৮ টাকা। ব্যবসায়ীরা মার্চ থেকে লিটারে আরো ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার রাজি না হলে সেদিন থেকে বাজারে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। এরপর হঠাৎ বাজার ঘাটতি উধাও হয়ে যায় সয়াবিন। সরকার ভোজ্যতেল উৎপাদন ও বিক্রির ওপর থেকে ভ্যাট পুরোপুরি আর আমদানিতে ৫ শতাংশ রেখে বাকি সব ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। পরে গত ২০ মার্চ লিটারে ৮ টাকা কমিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ঠিক করা হয় ১৬০ টাকা। সেদিন পাঁচ লিটারের বোতল ৭৯৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৭৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের দাম ১৪৩ টাকা থেকে কমিয়ে ১৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর গত ৫ মে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকায় বিক্রি হয় সয়াবিন তেল। তবে তখনই বাজারে আরো বেশি দামে বিক্রি হয় পণ্যটি। এরপর আবারো ৭ টাকা বাড়ে ২০৫ টাকা হয় তেলের দাম। এরপর দুই দফা কমিয়ে ১৮৫ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এরপর একমাস যেতে না যেতেই বোতলজাত সয়াবিনে ৭ টাকা ও খোলায় ৯ টাকা বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। যা গতকাল থেকেই কার্যকর হয়। নতুন করে এই দাম বৃদ্ধির ফলে আবারো বেকায়দায় পরে সাধারণ মানুষ।
সমিতির সচিব নুরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমলেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণে আমরা লিটারে দাম ২০ টাকা করে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৯ টাকা ও বোতলের সয়াবিন তেল লিটারে ৭ টাকা করে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সমিতির চিঠিতে বলা হয়, গত ৩ অক্টোবর সয়াবিন তেলের মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সে অনুযায়ী গত ১৭ আগস্ট আলোচনার পর মূল্যবৃদ্ধির এই ঘোষণা দেয়া হলো। ২৩ আগস্ট থেকে নতুন এই দাম কার্যকর হবে।
ক্রেতার নাভিশ্বাস: প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম চড়া। বাজারে গিয়ে ক্রেতার নাভিশ্বাস উঠেছে। ভোজ্যতেল যেহেতু ক্রেতার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, তাই এই পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে কেনার ক্ষমতা হারাচ্ছে ভোক্তা। পড়ছে বাড়তি চাপ। ক্রেতারা বলেন, সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি এর আগেও করা হয়েছে। এবারও একই কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ক্রেতাদের স্বার্থ দেখবে কে?
বাড্ডা বাজারে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতা সিদ্দিক হোসেন বলেন, ‘বেতন বাড়ছে না। অথচ সবকিছুর দাম বাড়ছে। ভয়াবহ এক সংকট সামনে এসেছে। আগে সংসারে যে পরিমাণ তেল প্রয়োজন হতো, এখন তা প্রায় অর্ধেক কমিয়েও সামাল দেয়া যাচ্ছে না।’
রামপুরা বাজারের নারগিস আক্তার নামের এক ক্রেতা দাম বৃদ্ধির খবরে বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন, পাঁচশ’ টাকা হবে কবে? এভাবে ধীরে ধীরে ১০/২০ টাকা দাম না বাড়িয়ে একসঙ্গে ৫০০ টাকা বাড়ালেই হয়। যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে আগামীতে তেল খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ