ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাত হলেই ওড়ে টাকা

প্রকাশনার সময়: ২০ আগস্ট ২০২২, ১২:১৬

রাত হলেই টাকা ওড়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকায়। স্পা সেন্টার-মদ-জুয়া-ডিসকোবার ও সিসার পেছনে ব্যয় হয় এসব টাকা। মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে উঠতি বয়সের তরুণী ও গৃহবধূরা। এদের পেছনে টাকা ওড়ানোর তালিকায় ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা। এ ধরনের কারবারকে ঘিরে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরায় গড়ে উঠেছে একটি বিশাল সিন্ডিকেট।

গত বছর র‍্যাব-পুলিশের অভিযানে মৌ-পিয়াসাসহ অনেকে গ্রেফতার হওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সম্প্রতি তারাই মৌ-পিয়াসার সাম্রাজ্য দখলে নিয়ে মাঠে নেমেছে একাধিক ছোট ছোট গ্রুপ। তাদের পেছনে রয়েছে অদৃশ্য শক্তি। তারাই প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে রাতের খেলায় মেতে উঠেছে বলে নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

অভিযোগ রয়েছে— বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীরা তাদের উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের জন্য বেছে নিয়েছে রাতের ঢাকাকে। আবার অনেকে পরিবারের অভাব ও নিজের পড়াশোনার খরচ মেটাতে পা দিয়েছে এ পথে। এদের সবাই এখন মাদকাসক্ত। আবার অনেকে জড়িয়ে পড়েছেন মাদক কারবারে। এভাবে তারা মাসে আয় করছেন লাখ টাকা।

যদিও গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের দাবি— বার ও সিসা লাউঞ্জসহ এ ধরনের কারবার দেখভালের দায়িত্ব মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। তারপরও সেখানে অপরাধমূলক কোনো কর্মকাণ্ড যেন না ঘটে এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকে। কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়।

গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান নয়া শতাব্দীকে বলেন, গত দেড় বছরের অন্তত ২৫টি স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়ে অন্তত শতাধিক তরুণ-তরুণীকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তারাই জামিনে বেরিয়ে স্থান বদল করে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা করছে। কখনো বনানী আবার কখনো তারা গুলশানে বাসা ভাড়া নেয়। তবে পুলিশ খবর পাওয়া মাত্রই অভিযান চালায়।

তিনি বলেন, স্পা সেন্টারে সেবা নিতে আসা বেশিরভাগই ধর্নাঢ্য পরিবারের সন্তান। আবার সেখানে কর্মরত নারী সদস্যদের অনেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন।

জানা গেছে, শুধু স্পা সেন্টারই নয়— বনানী ও গুলশান এলাকায় রয়েছে একাধিক বার। এসব বারে নারীরা নিয়মিত আসেন। তারা বিভিন্ন খদ্দেরকে মদ পরিবেশন করে থাকেন। এ সময় তাদের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর তারা চুক্তিতে মেলামেশা করে থাকেন। এক্ষেত্রে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন করা হয়। যার একটি অংশ পায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরে ওই টাকা বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করা হয়। অনেক সময় খদ্দেরকে সময় দিতে গিয়ে নারীরাও মাদক সেবন করে থাকে। এক পর্যায়ে তারাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে খরচের টাকা মেটাতে পা বাড়ান মাদক ব্যবসায়। এর সংখ্যা এখন প্রায় ২০ লাখ।

বিশেষজ্ঞদের মতে— নারীদের মাদক গ্রহণের হার বৃদ্ধি সমাজের জন্য অশনিসংকেত। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক তরুণীর জীবনের গল্প অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু মাদকের ছোবল তার জীবনের সব কিছু উলট-পালট করে দিয়েছে। এই তরুণীর মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেকেই শখের বসে, এমনকি স্বামীর মাধ্যমেও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন।

পার্টিতে আসা তরুণীদের দাবি— রাত হলেই ধোঁয়ার সঙ্গে ওড়ে টাকা। ডিজে গানের তালে তালে মদ আর সিসার ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দেয়া হয় টাকা। রাত শেষে এই টাকার একটা ভাগ পায় হোটেল কর্তৃপক্ষ। বাকি টাকাটা যায় মেয়েদের পকেটে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত ৬ জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীর দাবি— প্রথম পর্যায়ে শখের বসে তারা সময় কাটাতে আসেন। এরপর সিন্ডিকেটের সদস্যদের চোরাবালিতে হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। সেখান থেকে আর বের হওয়া সম্ভব হয়নি। একদিকে আর্থিক সচ্ছলতা অন্যদিকে উন্মাদনা। এই ঘোরের মাঝেই তারা এখন সময় পার করছেন।

সোনিয়া নামে এক তরুণী জানান, একটি রেস্টুরেন্ট হঠাৎ পরিচয় হয় একজন বড় আপুর সঙ্গে। কিন্তু জানা ছিল না কী করেন সেই আপু। পরিচয়ের এক দিন পর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আমন্ত্রণ করা হয় সোনিয়াসহ কয়েকজন উঠতি বয়সের সুন্দরী মেয়েদের। সেখানে চলে রাতভর আড্ডা। এতেই মন কেড়ে নেয় তাদের। রাত শেষে হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় ১০ হাজার টাকা। এবার লোভে পড়ে যান সোনিয়া। আর ফেরা হয়নি তার। এখন সে বিভিন্ন নামিদামি হোটেল, বার আর মাদক কারবার করে সময় কাটে তার।

সোনিয়া জানান, আমার প্রতিদিন পাঁচ থেকে ১০টি ইয়াবা সেবন করতে হয়। না করলে মাথা ঠিক থাকে না। টাকা ম্যানেজ করতেই জড়িয়ে পড়ি মাদক ও দেহব্যবসার সঙ্গে। আগের জীবনে ফিরতে চান কিনা জানতে চাইলে সোনিয়া বলেন, সুযোগ নেই। আর ফিরেই কী করব বলেন? গরিব পরিবারে জন্ম। ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা ও ছোট ভাই-বোন সবাইকে খুশি রাখতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও বাধ্য হয়েই ফিরতে পারছি না।

জানা গেছে, পড়াশোনার ফাঁকে মাঝে মধ্যে পার্টি করে যে টাকা উপার্জন হয় তা দিয়ে উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন হয় না অনেকের। ওই টাকায় তাদের পরিবারের খরচও বহন করতে হয়। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএপড়ুয়া তন্বী জানান, তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ঢাকায় এসে পড়াশোনার খরচ আর নিজের চলাফেরা করতে হিমশিম খেতে হয়। এমন চিন্তার এক পর্যায়ে হোস্টেলের এক বড় আপুর সঙ্গে নিজের কথাগুলো শেয়ার করেন তন্বী। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তন্বীকে।

তন্বী নয়া শতাব্দীকে বলেন, কয়েকদিন পর আপু তার কয়েক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করে দেয়। সেই রাতে এক বন্ধুর বাসায় চলে আড্ডা। সেখানে বসে মাদকের আসর। প্রথমে খেতে না পারলেও এক সময় দেখলাম ভালোই লাগছে। সেদিন থেকে শুরু। সেই রাতে অনেক কিছুই হয়েছে। যা মুখে আনা সম্ভব নয়।

তন্বী বলেন, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও থেকে ডাক আসে। আজ এখানে তো কাল অন্যখানে। এভাবে বিলাসবহুলভাবে চলতে পারছি। পরিবার থেকে এখন আর টাকা নেয়া লাগে না। উল্টো বাবার কাছে পাঠাই। বাবা জানে আমি একটা চাকরি করছি প্রাইভেট কোম্পানিতে। আগে রিকশায় চড়তে পারতাম না এখন প্রতি রাতে পাজেরো, প্রাডো ও বিএমডাব্লিউ গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াই।

এ গল্প শুধু সোনিয়া, তন্বীর নয় এমন ঘটনা রাজধানীজুড়ে অনেকের। কেউ জীবনের তাগিদে, কেউ বা সুন্দর জীবন উপভোগ করতে জড়িয়ে পড়ছে এ পেশায়। রাজধানীর নামিদামি হোটেলগুলোতে প্রতিরাতেই ভিড় করে নামিদামি গাড়ির সারি। চলে রাত ভর আড্ডা।

মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা-মানসের জরিপ বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি মাদকাসক্ত রয়েছে। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ২০ লাখ। তাদের হিসেবে, ১০ বছর আগেও নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ লাখ।

তবে আইসিডিডিআরবির জার্নাল অব হেলথ পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশনের জরিপে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমান মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। যার মধ্যে নারীমাদকাসক্তের সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাদক গ্রহণের ফলে নারীরা পুরুষের তুলনায় মানসিকভাবে বেশি বিষণ্ন হয়ে পড়ে। নারীদের শারীরিক ঝুঁকিও বেশি। নারীদের মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে পারিবারিক জীবনের হতাশা অনেকাংশে দায়ী বলে জানান এই মনোবিজ্ঞানী।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ