ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ ভাষণ(২)

দুর্নীতিবাজদের খতম করুন: বঙ্গবন্ধু

প্রকাশনার সময়: ০৬ আগস্ট ২০২১, ০১:০৮ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২১, ০১:১১

(১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী ঘোষণা করেন।)

দুঃখের বিষয়, তারা রাতের অন্ধকারে পাঁচজন পার্লামেন্ট সদস্যকে হত্যা করেছে, তিন/চার হাজারের মত কর্মীকে হত্যা করেছে। আরেক দল দুর্নীতিবাজ টাকা-টাকা, পয়সা-পয়সা করে পাগল হয়ে গেছে। তবে যেখানে খালি দুর্নীতি ছিল গত দুই মাসের মধ্যে সেখানে ইন্শাল্লাহ কিছুটা অবস্থা ইম্প্রুভ করেছে। দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য আজকে কিছু করা হয়েছে। হ্যা,প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম অব গভর্নমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন দুইজন তিনজনকে নমিনেশন দেয়া হবে।

জনগণ বাছবে কে ভাল কে মন্দ। আমরা চাই শােষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শােষকের গণতন্ত্র-এটা পরিষ্কার। আমি প্রােগ্রাম দিয়েছি। আজকে আমাদের সামনে কাজ কি? আজকে আমাদের সামনে অনেক কাজ। আমি সকলকে অনুরােধ করবাে। আপনারা মনে কিছু করবেন না, আমার কিছু উচিত কথা কইতে হবে। কারণ আমি কোনদিন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই। সত্য কথা বলার অভ্যাস আমার আছে। মিথ্যা বলার অভ্যাস আমার নাই। কিন্তু কিছুটা অপ্রিয় কথা বলবাে। বন্যা হলাে। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পেল, হাজার হাজার লােক না খেয়ে মরে গেল। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে আনলাম। ৫,৭০০(পাঁচ হাজার সাতশ”) লঙ্গরখানা খুললাম মানুষকে বাঁচাবার জন্য। সাহায্য নিয়েছি মানুষকে বাঁচাবার জন্য। আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা! আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে দুইটা কথা ছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায় যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পড়তে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না। আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ, যে নাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ, যে ব্লাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ, যে হােউ রে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যার বেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশ বিক্রী করে তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। আমি কেন ডাক দিয়েছি। এই ঘুনে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানী আমলের যে শাসন ব্যবস্থা তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সেজে গড়তে হবে। তাহলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে, না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখে শুনে আমি স্থির বিশ্বাসে পৌছেছি। এবং তাই জনগণকে পৌছিয়ে দিতে হবে শাসনতন্ত্রের মর্মকথা। আজকে জানি, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। আমাদের চেয়ে অধিক কে জানতে পারে? বাংলার কোন্ থানায় আমি ঘুরি নাই, বাংলার কোন জায়গায় আমি যাই নাই, বাংলার মানুষকে আমার মত কে ভাল করে জানে? আপনারা দুঃখ পান, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, আপনাদের গায়ে কাপড় নাই, আপনাদের শিক্ষা দিতে পারছি না। কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিস খাদ্য।

দুর্নীতিবাজদের খতম করুন

একটা কথা বলি আপনাদের কাছে সরকারী আইন করে কোন দিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয় জনগণের সমর্থন ছাড়া। আজকে আমার একমাত্র অনুরােধ আপনাদের কাছে, সেটা হলাে এই, আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে জেহাদ করতে হবে শক্রর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলবাে বাংলার জনগণের এক নম্বর কাজ হবে, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। কেমন করে করতে হবে। গণআন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামবাে। এমন আন্দোলন করতে হবে, যে ঘুষখাের, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখখার, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিক বয়কট করতে হবে। একথা মনে রাখতে হবে। গ্রামে গ্রামে মিটিং করে দেখতে হবে কোথায় ঐ ঐ ব্লাকমার্কেটিয়ার, ঐ ঘুষখাের। ভয় নাই কোন ভয় নাই, আমি আছি। ইনশাআল্লাহ আপনাদের চোর , উপর অত্যাচার করতে দেব না। কিন্তু আপনাদের গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করতে। হবে । আন্দোলন করতে পারে কে? ছাত্র ভাইরা পারে, পারে কে? যুবক ভাইরা পারে, পারে কে? বুদ্ধিজীবীরা পারে , পারে কে? জনগণ পারে। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন। ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে।

যদি দুর্নীতিবাজদের খতম করতে পারেন তা হলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে । এত চোরের চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই চোরা তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম। এই চোর রেখে গিয়েছে। কিছু দালাল গিয়েছে , চোর গেলে বেঁচে যেতাম। জমির উৎপাদন বৃদ্ধি করুন। দ্বিতীয় কথা, আপনারা জানেন- আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয় , জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুন বেশি ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সে জমিতে ডবল ফসল করতে পারব না, দ্বিগুন করতে পারব না । আমি যদি দ্বিগুন পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না। ভিক্ষা করতে হবে না।

ভাইয়েরা আমার, বােনেরা আমার। ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই । একটা লােককে আপনারা ভিক্ষা দেন টাকা কি আট আনা। তারপর তার দিকে কিভাবে চান, বলেন, “ও বেটা ভিক্ষু , যা বেটা নিয়ে যা আট আনা পয়সা। ” একটা জাতি যখন ভিক্ষুক হয়, মানুষের কাছে হাত পাতে, আমারে খাবার দাও, আমারে টাকা দাও, সেই জাতির ইজ্জত থাকতে পারে না। আমি সেই ভিক্ষুক জাতির নেতা থাকতে চাই না। আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট পরা, কাপড় পরা ভদ্রলােক তাদের কাছেও চাই- জমিতে যেতে হবে , ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ঐ শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ হবে না। ভিক্ষুকের মতাে হাত পাততে হবে না। আমি পাগল হয়ে যাই চিন্তা করে। এ বৎসর '৭৫ সালে আমাকে ছয় কোটি মণ খাবার আনতে হবে। কি করে মানুষকে বাঁচাবাে? কি করে অন্যান্য জিনিস কিনবাে? অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্র সাহায্য দিচ্ছে বলে বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না । আমাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে পায়ের উপর দাঁড়াতে হবে জাতি হিসেবে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

ভাইয়েরা আমার, একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লােক বাড়ে। আমার জায়গা হল ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলায় কোন জমি থাকবে না চাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হল ৩ নম্বর কাজ। এক নম্বর হল- দুর্নীতিবাজ খতম করা, দুই নম্বর হল- কারখানায়, ক্ষেতে খামারে প্রােডাকশন বাড়ান, তিন নম্বর হল- পপুলেশন প্ল্যানিং , চার নম্বর হল- জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য একদল করা হয়েছে। যারা বাংলাকে ভালবাসে, এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মানে, সৎপথে চলে তারা সকলেই এই দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশী এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ। থেকে পয়সা নেয় , এতে তাদের স্থান নাই। সরকারী কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এই জন্য সকলে যে যেখানে আছি একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগতে হবে। জাতীয় দলের ব্রাঞ্চ ভাইয়েরা, বােনেরা আমার, এই জাতীয় দলের আপাতত ৫ টা ব্রাঞ্চ হবে। একটা শ্রমিক ভাইদের অংগদল, কৃষক ভাইদের একটা, যুবক ভাইদের একটা, ছাত্রদের একটা এবং মহিলাদের একটা। এই ৫ টা অংগদল মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। আমাকে অনেকে বলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ হলে আমাদের কি হবে। আমি বলি আওয়ামী লীগ মানে তাে জনগণ, ছাত্র, যুবক, শিক্ষিত সমাজ, সরকারী কর্মচারী সকলে মিলে, কৃষক শ্রমিক সকল কর্মচারী মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। শিক্ষিত সমাজকে আমি অনুরােধ করব, আমরা কতজন শিক্ষিত লােক, আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লােক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত। তাদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন। চলবে...

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ