ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার প্রিয় বাঙালির কাছ থেকে আলাদা করতে পারেননি। এখনো এই বাংলা ও বাঙালির সবটুকুজুড়ে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান। কবির ভাষায়- ‘অনেক নিচে মর্ত্যের এক চারকোনা ঘরে লেখার টেবিলে বসে আছি/আমার চোখ ভিজে গেল/আমি পাশ-টেবিলে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,/কে বলেছে আপনি নাই, এই তো আপনি আছেন- এইখানে,/সবখানে, সমস্ত বাংলায়- /এইখানে বাংলার লাল ও সবুজে/ আমাদের অশ্রু আর ভালোবাসায়,/আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার/আর এগিয়ে যাওয়ার অমোঘ মন্ত্রে-/‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না...।’
১৯৭৫ সালের ৮ আগস্ট ছিল শুক্রবার। এদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। বঙ্গমাতা শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী নন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে তিনি নীরবে-নিভৃতে অবদান রেখেছেন। জাতিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে স্বাধীনতা অর্জনে তার ভূমিকা কোনোদিন জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি। বঙ্গমাতার মতো একজন অসমসাহসী, ধৈর্যশীল, সৎ পরামর্শদাতা স্ত্রী পাশে থাকার কারণেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জাতির জন্য লড়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময়গুলোতে বঙ্গমাতাই পরম যত্ন ও বিচক্ষণতায় সংসার ও দল উভয়ই আগলে রেখেছেন। আওয়ামী লীগের দলীয় কাজকর্ম, আন্দোলন-সংগ্রামে নিজের সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা। পরিবারকে কখনো বঙ্গবন্ধুর অভাব বুঝতে দেননি। কৌশলে সেসব অভাব মেটাতেন আর সদস্যদের ভিন্নভাবে বোঝাতেন। নবীন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ আলোচনায় বঙ্গমাতার জীবনী অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উদ্ভাসিত। খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হচ্ছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
প্যারোল মুক্তি নিয়ে বা মুচলেকা দিয়ে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেয়া সম্পর্কিত দলের কতিপয় নেতার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে বন্দি মুজিবের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করলে তার সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধামতো যে কোনো সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে বলে আরো পরে তিনি তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সাবধান করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চের ভাষণের আগেও অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দিলেও সঠিক পরামর্শটি দিয়েছিলেন তার সহধর্মিণীই। তিনি বঙ্গবন্ধুকে একটি কথাই বলেছিলেন, তিনি যেন তার নিজের মনে যা আছে, তাই, ওই ভাষণে বলেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালে প্যারোল মুক্তি নিয়ে বা মুচলেকা দিয়ে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিলে যোগ দেয়া সম্পর্কিত দলের কতিপয় নেতার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠিয়ে অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন বঙ্গমাতা। রণমূর্তি ধারণ করে সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছেন, প্যারোল মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন, কিন্তু, তাতে তার জীবনের তরে ৩২ নম্বরে আসা বন্ধ হবে।
প্রয়াত সাংবাদিক এবং লেখক এবিএম মূসা তার ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে লেখেন, ‘শেখ মুজিব যদি মুচলেকা দিয়ে সহবন্দীদের ক্যান্টনমেন্টে রেখে রাওয়ালপিন্ডি যেতেন এদেশের ভবিষ্যৎ ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।’
এবিএম মূসা আরো লিখেন, ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলছে। সাল ১৯৬৯। গণ-অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। কিন্তু, পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হয় কী করে? শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান বৈঠক সফল করতে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বাধ্য হলেন কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানাতে। কিন্তু দেশদ্রোহের দায়ে বিচারের আসামি, ক্যান্টনমেন্টে বন্দি মুজিব আসবেন কীভাবে?
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ