জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে গোটা জাতি। সেই আগস্টের ৭তম দিন আজ। ১৯৭৫ সালের ৭ আগস্ট ছিল বৃহস্পতিবার। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও বাঙালির হূদয়ের আসনে তিনি চির ভাস্বর, চির অম্লান। বাঙালির হূদয়ের মণিকোঠায় তিনি অধিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় রচিত হচ্ছে সাহিত্য, ছড়া, কবিতা ও গান। কবির ভাষায়— ‘একটি মানুষ বুঝি হয়ে যায় একটি পতাকা/একটি মানুষ বুঝি হয়ে যায় একটি স্বদেশ/একটি মানুষ বুঝি হয়ে যায় ছিন্নপত্রে আঁকা/একটি মানুষ বুঝি হয়ে যায় অনির্বাণ রেশ।’
১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য, আত্মীয়-স্বজন। সেদিন দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় গোটা বিশ্বে নেমে আসে শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। সে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দ্য টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়— ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই’। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসাবে বিবেচনা করবে’। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে থেমে থাকেনি। এরপর তার বেঁচে যাওয়া কন্যা শেখ হাসিনাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করে তারা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী, আওয়ামী লীগের সেই সময়ের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র এখনো থামেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথমত একজন জননেতা এবং আন্দোলনকারী মানুষ। আজীবন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ এবং একজন সন্মোহনী বক্তা হিসেবে তিনি বৃষ্টিস্নাত শত সহস্র জনতাকে আগুনের উত্তাপে আলোড়িত করতে পারেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সার্বজনীন সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরপরেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমেরিকার মূল্যায়ন ছিল এরকমই। তাদের বর্ণনায় শেখ মুজিব ছিলেন এক সন্মোহনী বক্তা, যিনি তার রাজনৈতিক দক্ষতাকে কর্তৃত্বের সঙ্গে কাজে লাগাতে পারেন। বাঙালিদের মধ্যে তার এমন প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই, এমন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কেউ নেই যিনি তাকে ছাড়িয়ে যাবেন।
আমেরিকান কূটনীতিকদের চোখে শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। নির্বাচনের তিনদিন পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠিয়ে শেখ মুজিব সম্পর্কে তাদের মূল্যায়নে লেখেন, ‘৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান এক দলীয় রাজ্যে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই অবাক করা বিজয় দলের বিজয়ের চেয়েও ব্যক্তির একক ভাবমূর্তির বিজয়। সব ক্ষমতাশালী দলের কাছে অবিতর্কিত নেতা হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও এমন বিজয়ের খুব একটা অবাক হননি মুজিব। আমেরিকান কূটনীতিকদের ছয় মাস আগেই কথা প্রসঙ্গে এমন বিজয়ের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
আর্চার ব্লাড এখানেই থেমে থাকেননি। শেখ মুজিবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি লিখেন— ‘মুজিব আজীবন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। আমরা যতদূর জানি, তিনি আইনের ডিগ্রি না নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। কখনো কোনো চাকরি বা ব্যবসায় নিয়োজিত হননি। তার দৃষ্টিগ্রাহ্য আয়ের উৎস হচ্ছে গ্রেট ইস্টার্ন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ।’
একান্ত বৈঠক ও সাক্ষাতে তিনি (মুজিব) চমৎকার, শান্ত এবং আত্মপ্রত্যয়ী উল্লেখ করে আর্চার বলেন, ‘ভুট্টোর মতো বিশ্বজনীন আভিজাত্য তার নেই। তবে তিনি বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন এবং নাগরিক জীবনের মানুষ।
নিন্দুকরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কী ধারণা করে তাও তুলে ধরেন আর্চার। নিন্দুকদের মতে, শেখ মুজিবের বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা ছিল কম এবং ক্ষমতার জন্য লোভী। এর জবাবে অবশ্য আর্চার বলেন, যদিও তিনি বুদ্ধিজীবী নন তবুও একান্ত বৈঠকে মুজিব উল্লেখযোগ্য মানসিক চৌকসতা প্রদর্শন করে থাকেন এবং তার রসবোধও যথেষ্ট।
তবে ১৯৭৩ সালে আমেরিকান মিশন বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নে আগের অবস্থান থেকে একটু সরে আসে বলে মনে করা যেতে পারে। মিশনের মতে, শেখ মুজিব রাজনৈতিক জীবনে বৈদেশিক নীতি বা বিষয়াবলি নিয়ে খুব একটা মনোযোগ দেন নাই। তিনি যেভাবে বিশ্বকে বিশ্লেষণ করেছেন তাতে বিশ্বজনীন বিষয়ে গভীর উপলব্ধি ছিল না বলেই মনে হয়। এই সময় মিশন লেখে ‘সর্বোপরি তিনি (মুজিব) ছিলেন প্রাদেশিক বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক। এর থেকে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমেরিকান বিরোধী নন। তিনি আমেরিকা কিংবা এর উদ্দেশ্যবলির বিরোধিতা করেন না। তবে যারা তীব্র শব্দ করেন, তাদের চড়কায় তিনি তেল দেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের কথা বলা যায় এক্ষেত্রে।’
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ