’৭৫-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে শুরু হয় নানা অরাজকতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার ধারাবাহিক অপচেষ্টা চলে। স্বাধীনতাবিরোধীরা উদার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করতে উঠেপড়ে লাগে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, উদার সংস্কৃতিমনাদের মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল হয়ে পড়ে কোণঠাসা। দেশে ফিরে আসতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধীরা। রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় পাকিস্তানের দোসরদের।
পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ ঘোর অমাবস্যায় ডুবে থাকা এক জনপদের নাম। একটা সময় পর্যন্ত অবস্থা এমন ছিল যে, কোনো আশা নেই, ভালোবাসা নেই, আছে শুধু লোমহর্ষক হত্যা আর ষড়যন্ত্রের জাল বুননের নানা কাহিনী। প্রতি মুহূর্তেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটেছে আর মৃত্যু হতে থাকে বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালির স্বপ্নগুলোর। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বপ্নগুলোকে হায়েনার দল ক্ষতবিক্ষত করে যেন প্রতিশোধের উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর সংবিধানকেও কাটাছেঁড়া করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোকে বিদায় করতে চেয়েছিল দখলদার অপশক্তি।
ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় সুকৌশলে বসানো হয় রাষ্ট্রধর্ম শব্দটি। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গা’ দখল করে নেয় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। দেশের রাজনীতিই আমূল পরিবর্তিত হতে থাকে। যেসবের মাধ্যমে পাকিস্তানি ভাবধারাকে ফিরিয়ে এনে স্থায়ী করার অপচেষ্টা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে বিসর্জন দেয়া হয় সবার আগে। ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ অনুসরণ করে প্রচলন করা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। একইভাবে ‘বাংলাদেশ বেতার’ নাম পাল্টে করা হয় ‘রেডিও বাংলাদেশ’। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও পাকিস্তানি হানাদারদের দালালদের সুযোগ করে দেয়া হয় রাজনীতি করার।
১৯৭১ সালে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর মানবতাবিরোধী ও দালালদের অপরাধের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এক অধ্যাদেশ জারি করে। এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী সারা দেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ আইনে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে গ্রেফতার এবং অনেককে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও দেয়া হয়। কিন্তু যেসব অপরাধে এ বিচার চলছিল, তাতে অনেক জায়গা থেকে অনেকের ব্যক্তিগত ইস্যুও এতে জড়ানো হচ্ছিল। এ রকম অনেক অভিযোগের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর এক আদেশে দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অভিযুক্তরা ছাড়া অন্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি ও ক্ষমতালোভী চক্র সরকারে এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইনই বাতিল করে দেয়। সব যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার ও অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। শহিদদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। ৩ মে ১৯৭৬ এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় তৎকালীন সরকার। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল সংবিধানের নবম সংশোধনীর মাধ্যমে তা আইনে পরিণত করা হয়। এর ফলে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামে ইসলামসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো আবার তাদের তৎপরতা শুরু করে। রাষ্ট্র-সমাজ আর রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সুপরিকল্পিতভাবে এ দেশে জাতীয়তা ও নাগরিকতার ধারণাকে নিয়ে একটি তালগোল পাকিয়ে ফেলার আয়োজন করা হয়। যা ছিল মূলত ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে জাতিকে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্য পরিকল্পনা। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পঠন-পাঠনের উদ্যোগ স্কুল পর্যায়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ হেরে যায়নি। দুই দশকের বেশি সময় পর রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর ফিরে আসে সেই অবিনাশী স্লোগান ‘জয় বাংলা’। এই স্লোগান এখন জাতীয় স্লোগান।
১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের অন্তত ১৫ মাস আগেই অভ্যুত্থান নিয়ে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। অভ্যুত্থানের পর বিদেশি কোনো শক্তি, বিশেষ করে ভারত যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেই দিকটা আমেরিকা দেখবে কিনা সেটাও যাচাই করতে চেয়েছিল তারা।
শুধু তাই নয়, এর আগেও তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য আমেরিকা থেকে অস্ত্র কেনার ছল করে তথ্য জানতে আমেরিকান দূতাবাসে যায়। তারা সেখানে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের কথা সেখানে ব্যক্ত করে।
আমেরিকান সাংবাদিক লেখক বি জেড খসরুর ইংরেজিতে লেখা ‘বাংলাদেশে মিলিটারি ক্যু সিআইএ লিঙ্ক’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। বি জেড খসরু তার বইতে লিখেন, ‘ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস এমন অভ্যুত্থানের কথা শুনেছিল ১৫ আগস্টের ঘটনার অন্তত ১৫ মাস আগে। ১৯৭৪ সালের ১৩ মে সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (বহিষ্কৃত) আগে থেকে না জানিয়েই আমেরিকান দূতাবাসের জনসংযোগ অফিসার উইলিয়াম গ্রেসামের বাসায় যান।’ ফারুক তাকে জানান, ‘ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে সে আমেরিকানদের মনোভাব জানার জন্য এসেছেন।’ তিনি বলেন, ‘তারা নিশ্চিত হতে চায় সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করলে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে। ফারুক তাকে বলে, বিদেশি কোনো শক্তি যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে দিকটা আমেরিকা দেখবে কিনা। ফারুক বিশেষ করে ভারতের কথা বোঝাতে চায়। ফারুক গ্রেসামকে জানায়, ‘সারা দেশে সেনা অভিযান চলাকালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ নেতাদের না ধরার জন্য যে আদেশ দিয়েছেন তাতে সেনাবাহিনী সরকারের ওপর ভীষণ চটে আছে।’ গ্রেসাম ফারুককে জানান, ‘আমেরিকা বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।’ ফারুকের এই সাক্ষাতের বিষয়টি দূতাবাস ওয়াশিংটন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে অবগত করে। তারা একে অস্বাভাবিক অ্যাপ্রোচ বলে আখ্যায়িত করে। তারা বলে, ‘গত দুই বছরে এটাই প্রথমবার সেনাবাহিনীর অসন্তোষের এবং ক্যু-এর খবর নয়। আগেও এমন কথা দূতাবাসের কানে এসেছে। কিন্তু এর কোনোটাই সত্য হয়নি। তারা আরো উল্লেখ করে, ফারুক ও রশীদ এক বছর আগেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য আমেরিকা থেকে অস্ত্র কেনার ছল করে তথ্য জানতে আমেরিকান দূতাবাসে গিয়েছিল। তখন তারা সেনা বাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করে।
ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস ২২ মার্চ আট পৃষ্ঠার এক বিশ্লেষণে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রশ্নমালার জবাব দেয়। ডেপুটি চিফ অব মিশন আরভিং চেসলো উল্লেখিত মেয়াদের মধ্যে কেন অভ্যুত্থান ঘটতে পারে তার বিশ্লেষণ করে লিখেন, ‘বাকশাল গঠিত হওয়ায় ভারতপন্থি ও সোভিয়েটপন্থি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবের ক্ষমতা সুসংহতকরণের আগেই হয়তো তারা অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। তবে, তাদের মধ্যে যেমন ধৈর্যহীনতা আছে, তেমনি আছে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়।’ আমেরিকান দূতাবাস প্রেরিত স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি গোপন দলিলে বলা হয়েছে, ‘ক্যু এর পরিকল্পনা হয়েছে সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে। রিপোর্টে বিশদ কিছু না থাকলেও ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান সম্পর্কে ঢাকায় আমেরিকান এক্সপ্রেসে কর্মরত ফিনলে মোদি তার কোম্পানিকে লিখে জানান, জুনিয়র সেনা অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত এই অভ্যুত্থান দক্ষিণপন্থি ও ইসলামপন্থিদের বলে মনে হয়। এতে বেশির ভাগ সেনার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। সেনাবাহিনী বিভক্ত হয়ে আছে। ভবিষ্যতে এর বিরুদ্ধে পাল্টা ক্যু হতে পারে। নিউইয়র্কে অবস্থিত কোম্পানির সদর দফতরে পৌঁছে দেয়ার জন্য ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস তার এই বার্তাটি ওয়াশিংটনে পাঠায়।’
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ