১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
আমার ভাই ও বোনেরা, আজ ২৬ শে মার্চ , ১৯৭৫ সাল। একাত্তরের ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষকে আক্রমণ করেছিল। হাজার হাজার, লাখ লাখ লোককে হত্যা করেছিল। সেদিন রাতে বিডিআর-এর ক্যাম্পে, পুলিশ ক্যাম্পে , আমার বাড়ীতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চারিদিকে আক্রমণ চালায় ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশবিক শক্তি নিয়ে। বাংলার মানুষকে আমি ডাক দিয়েছিলাম । যখন দেখলাম আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে, সে মুহূর্তে আবার আমি ডাক দিয়েছিলাম, ৭ ই মার্চ আমি তাদের প্রস্তুত করে দিয়েছিলাম যে আর নয়, মোকাবেলা কর। বাংলার মানুষ যে যেখানে আছ, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রদের মোকাবেলা কর। বাংলার মাটি থেকে শত্রুকে উৎখাত করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীন করতে হবে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না ।
দুনিয়ার মানুষের কাছে আমি সাহায্য চেয়েছিলাম। আমার সামরিক বাহিনীতে যারা বাঙালী ছিল ,আমার পুলিশ, আমার বিডিআর , আমার ছাত্র , যুবক ও কৃষকদের আমি আহবান করেছিলাম। বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে মোকাবেলা করেছিল। ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছিল। দুনিয়ার জঘন্যতম ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানী শোষক শ্রেণী। দুনিয়ার ইতিহাসে এত রক্ত স্বাধীনতার জন্য কোন দেশ দেয় নাই, যা বাংলার মানুষ দিয়েছে। শুধু তাই না , তারা এমনভাবে পঙ্কিলতা শুরু করল, যা কিছু ছিল ধ্বংস করতে আরম্ভ করেছি। ভারতে আমার এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল, তার জন্য আমরা নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করব। আমি তাদের স্মরণ করি খোদার কাছে মাগফেরাত কামনা করি, যারা এ দেশের স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়েছে , আত্মাহুতি দিয়েছে আমি তাদের কথা স্মরণ করব যে সকল মুক্তিবাহিনীর ছেলে, যেসব মা - বোনেরা , আমার যে কর্মী বাহিনী যারা আত্মাহুতি দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশ তাদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে। আজ আমি স্মরণ করি ভারতীয় সেনাবাহিনীর যারা জীবন দিয়েছিল বাংলার মাটিতে ।
একটা কথা। আপনাদের মনে আছে, তারা(পাক হানাদারেরা)যাবার পূর্বে ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে ১৬ই ডিসেম্বরের আগে, কারফিউ দিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করব, সম্পদ ধ্বংস করব, বাঙালী স্বাধীনতা পেলেও এই স্বাধীনতা রাখতে পারবে না। ইনশাল্লাহ বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা হয়েছে। বাংলার লোক স্বাধীন হয়েছে। বাংলার পতাকা আজ দুনিয়ায় ওড়ে। বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘের সদস্য। বাংলাদেশ আজ জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সদস্য, কমনওয়েলথ-এর সদস্য, ইসলামী সামিট- এর সদস্য। বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে , বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না। ভায়েরা, বোনেরা আমার , আমরা চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু একটা ওয়াদা আমি রাখতে পারি নাই। জীবনে যে ওয়াদা করেছি জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমরা সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। আমরা জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা কো-একজিস্টেনসে (Co existence) বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্ব শান্তিতে বিশ্বাস করি । আমরা ভেবেছিলাম, পাকিস্তানীরা নিশ্চয়ই দুঃখিত হবে, আমাদের সম্পদ ফেরত দেবে। আমি ওয়াদা করেছিলাম তাদের বিচার করব।
এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাফ করেছি, তাদের আমি বিচার করিনি। আমি ছেড়ে দিয়েছি এ জন্যে যে, এশিয়ায় দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানীরা আমার সম্পদ এক পয়সাও দিল না, আমার বৈদেশিক মুদ্রার কোন অংশ আমাকে দিল না। আমার গোল্ড রিজার্ভের কোন অংশ আমাকে দিল না। একখানা জাহাজও আমাকে দিল না। একখানা প্লেনও আমাকে দিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ এক পয়সাও আমাকে দিল না এবং যাবার বেলায় পোর্ট ধ্বংস করলা , রাস্তা ধ্বংস করলা, রেলওয়ে ধ্বংস করলা, জাহাজ ডুবিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত কারেন্সী নোট জ্বালিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানীরা মনে করেছিল যে, বাংলাদেশকে যদি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের মানুষকে আমরা দেখাতে পারবো যে, তোমরা কি করছো।
ভুট্টো সাহেব বক্তৃতা করেন। আমি তাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলাম, লাহোরে আমাকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বলে। ভুট্টো সাহেব বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা কি? ভুট্টো সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করি, ফ্রন্টিয়ারের পাঠানদের অবস্থা কি?ভুট্টো সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি বেলুচিস্তানের মানুষের অবস্থা কি? এরোপ্লেন দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করছেন। সিন্ধুর মানুষের অবস্থা কি? ঘর সামলান বন্ধু , ঘর সামলান। নিজের কথা চিন্তা করুন, পরের জন্য চিন্তা করবেন না। পরের সম্পদ লুট করে খেয়ে বড় বড় কথা বলা যায়। আমার সম্পদ আমাকে ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না। তোমরা আমার কি করেছ? আমি সবার বন্ধুত্ব কামনা করি । পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই কিন্তু আমার সম্পদ আমাকে দিতে হবে। আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই , কারো সঙ্গে দুশমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই। আমার মানুষ দুঃখী, আমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়। আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম, যখন জেল থেকে বের হয়ে আসলাম , তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাঙ্কে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না । আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না।
গত তিন চার বছরে না হলেও বিদেশ থেকে ২২ কোটি মণ খাবার আনতে হয়েছে। ২২ শ' কোটি টাকার মত বিদেশ থেকে হেল্প আমরা পেয়েছি সে জন্যে যারা আমাদের সাহায্য করছেন সে সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্রকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।কিন্তু আর একটি কথা। অনেকে প্রশ্ন করেন আমরা কি করেছি, আমরা যখন ক্ষমতায় আসলাম, দেশের ভার নিলাম তখন দেশের রাস্তাঘাট অবস্থায় পেলাম তাকে রিপেয়ার করার চেষ্টা করলাম। সেনাবাহিনী নাই, প্রায় ধ্বংস করে গেছে, পুলিশ বাহিনীর রাজারবাগ জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেই খারাপ অবস্থা থেকে ভাল করতে কী করি নাই। আমরা জাতীয় সরকার গঠন করলাম। আমাদের এখানে জাতীয় সরকার ছিল না, আমাদের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট ছিল, বৈদেশিক ডিপার্টমেন্ট ছিল না , প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট ছিল না। এখানে কিছুই ছিল না , তার মধ্যে আমাদের জাতীয় সরকার গঠন করতে হলো । যারা শুধু কথা বলেন তার বুকে হাত দিয়ে চিন্তা করে বলুন আমরা কি করেছি। এক কোটি লোককে ঘরবাড়ী দিয়েছি। রাষ্ট্রের লোককে খাওয়ানোর জন্যে বিদেশ থেকে খাবার আনতে হয়েছে। পোর্টগুলোকে অচল থেকে সচল করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ২২ কোটি মণ খাবার এনে বাংলার গ্রামে গ্রামে দিয়ে। বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হয়েছে।
তাই আজ কথা আছে। আমি মানুষকে বললাম , আমার ভাইদের বললাম , মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের বললাম, তোমাদের অস্ত্র জমা দাও। তারা অস্ত্র জমা দিল। কিন্তু একদল লোক আমার জানা আছে যাদের পাকিস্তান অস্ত্র দিয়ে গিয়েছিল তারা অস্ত্র জমা দেয়নি। তারা এসব অস্ত্র দিয়ে নিরপরাধ লোককে হত্যা করতে আরম্ভ করল। এমনকি পাঁচজন পার্লামেন্টের সদস্যকেও তারা হত্যা করল। তবুও আমি শাসনতন্ত্র দিয়ে নির্বাচন দিলাম। কিন্তু যদি বাংলার জনগণ নির্বাচনে আমাকেই ভোট দেয় সে জন্য দোষ আমার নয়। ৩১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৩০৭ সীট বাংলার মানুষ আমাকে দিলেন কিন্তু একদল লোক বলে, কেন জনগণ আমাকে ক্ষমতা দিল? কোন দিন কোন দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে কেউ কাউকে এভাবে অধিকার দেয় না। কিন্তু অধিকার ভোগ করতে হলে তার জন্যে যে রেসপনসিবিলিটি আছে সেটা তারা ভুলে গেলেন। আমি বললাম, তোমরা অপজিশন সৃষ্টি করো, সৃষ্টি করল। বক্তৃতা করতে আরম্ভ করলো।
অন্ধকারে মানুষ হত্যা করতে আরম্ভ করলো। দরকার হলে অস্ত্র দিয়ে আমাদের মোকাবিলা করতে চায়। অস্ত্রের হুমকি দেয়া হলো। মানুষ হত্যা থেকে আরম্ভ করে রেল লাইন ধ্বংস করে, ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী ধ্বংস করে , জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করলো যাতে বিদেশী এজেন্টরা যারা দেশের মধ্যে আছে তারা সুযোগ পেয়ে গেল। আমাদের কর্তব্য মানুষকে বাঁচানো। চারদিকে হাহাকার, স্বাধীনতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জিনিসের দাম আস্তে আস্তে বেড়ে গেল। সমস্ত দুনিয়া থেকে আমাদের কিনতে হয়। খাবার কিনতে হয়, কাপড় দিন হয়, ওষুধ কিনতে হয়, তেল কিনতে হয়। আমরা তো কলোনি ছিলাম, দু'শ বছর ইংরেজদের কলোনি ছিলাম, পঁচিশ বছর পাকিস্তানের কলোনি ছিলাম। আমাদের তো সবকিছুই বিদেশ থেকে কিনতে হয়। কিন্তু তার পরেও বাংলার জনগণ কষ্ট স্বীকার করে কাজ করতে আরম্ভ করেছেন। কিন্তু তারা এগুবার দেয় না,কাজ করতে দেয় না। আর একদল বিদেশে সুযোগ পেল, তারা বিদেশ থেকে অর্থ এনে বাংলার মাটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলো। স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করলো। আর এদিনে কেন বলছি একথা। অনেক বলেছি, এত বলার দরকার ছিল না। কিন্তু আমার চোখের সামনে মানুষের মুখ ভাসে, আমার দেশের মানুষের রক্ত আমার চোখের সামনে ভাসে, আমারই মানুষের আত্মা আমার চোখার সামনে সে সমস্ত শহীদ ভাইরা ভাসে যারা ফুলের মত ঝরে গেল, শহীদ হলো। তাদের আত্মার কাছে, রোজ কিয়ামতে কি জবাব দিব ‘আমরা রক্ত গিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, তোমরা স্বাধীনতা নস্যাৎ করেছো, তোমরা রক্ষা করতে পারনাই।'
কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য। কথা হলো এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে , অফিসে যেয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যায় , গাইন করিয়ে নেয়, ফ্রি-স্টাইল। ফ্যাক্টরিতে যেয়ে কাজ না করে টাকা দাবি করে । সাইন করিয়ে নেয়। যেন দেশে সরকার নেই। শ্লোগান হল-বঙ্গবন্ধু কঠোর হও।
বঙ্গবন্ধু কঠোর হবে। কঠোর ছিল, কঠোর আছে। কিন্তু দেখলাম, চেষ্টা করলাম। এত রক্ত, এত ব্যথা, দুঃখ দেখি কি হয়, পারি কি-না। আবদার করলাম, আবেদন করলাম, অনুরোধ করলাম, রিকোয়েস্ট করলাম, কামনা করলাম। চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। ভাইয়েরা, বোনেরা আমার, আজকে যে সিস্টেম করেছি তার আগেও ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর কম ছিল না। আমি বিশ্বাস করি না ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি, ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগণ যেদিন বলবে, “বঙ্গবন্ধু, ছেড়ে দাও "বঙ্গবন্ধু একদিনও রাষ্ট্রপতি, একদিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালোবেসে।বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষনহীন সমাজ কায়েম করার জন্য।
চলবে...
নয়া শতাব্দী/এসইউ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ