দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি। দল দুটির আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন, মত-মতান্তর, ঝগড়া, পক্ষ-বিপক্ষ তর্ক থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে যুদ্ধের যেমন নিয়ম আছে রাজনীতির কিছু নিয়ম আছে। সংসদের ভাষা ও মাঠ-ময়দানের ভাষা কখনো এক হতে পারে না। সংসদে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কোনো কথা বলা যায় না। মাঠের রাজনীতির ক্ষেত্রে সংসদের মতো অতটা পিউরিটান নয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যুক্তি দিয়ে বিরোধীদের কাবু করবেন। সংসদ ও মাঠের রাজনীতিতে বড় দুই দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সর্বত্র পক্ষে-বিপক্ষে চলছে উত্তপ্ত কথার লড়াই। এই লড়াইয়ে নেমেছেন কর্মীরাও। কথা দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন উভয় দলের নেতারা। প্রতিদিনই বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এ নিয়ে তারা বক্তব্য দিচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতারও যোগ দিয়েছেন কথার হাড্ডাহাডি লড়াইয়ে। বসে নেই মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতারা। পাল্টা জবাব দিচ্ছেন তারাও। কথার মারপ্যাঁচ দিতে বাদ যাচ্ছেন না ছোট দলগুলোর বড় নেতারাও।
জানা যায়, সম্প্রতি পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎ-লোডশেডিং ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বির্তক জড়িয়েছেন নেতারা। কথা ও যুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে ঝড় তুলেছেন। কথার রাজনীতির ঝড় শুরু হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমল থেকেই। তার হাত ধরেই সংসদ- মাঠের রাজনীতিতে কথার সূত্রপাত। স্বাধীনতার পর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল এবং বামদের ৫ দলীয় জোট রাজপথে যুগপত আন্দোলন করেছে। এরশাদের পতনের পরের অন্তত তিনটি সংসদে-মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানদের একাডেমিক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিম, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। আর বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মান্নান ভূইঁয়া, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সাদেক হোসেন খোকা, ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার, মীর শওকত আলী, ড. খন্দকার মোশাররফ, কর্ণেল অলি, একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ছিলেন অন্যতম। এদের প্রাণবন্ত বক্তব্য সরগরম থাকত সংসদ ও মাঠের রাজনীতি। উভয় দলের নেতাদেরও সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। তবে এখনকার রাজনীতিদের মধ্যে সেই সর্ম্পক আর নেই। তীব্র ঘৃণা বিরাজমান। অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে চলছে যুক্তি তর্কের কথা লড়াই। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যর কাউন্টার দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রহমান, মির্জা আজম অন্যতম। অপরদিকে আওয়ামী লীগের বক্তব্য পাল্টা জবাব দিচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, বারিস্টাার রুমিন ফারহানা, হারুন অর রশিদ উল্লেখ্যযোগ্য। প্রতিদিনই বিভিন্ন সভা-সেমিনার, সমাবেশ ও মানববন্ধনে অংশ নিয়ে উভয় দলের নেতারা দিচ্ছেন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। সরগরম রাজনীতির মাঠ। চলছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের বাগযুদ্ধ। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামকে রেখে দুই দলই দিচ্ছেন হুকার-হুশিয়ারি। বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে প্রস্তুত জনগণ। আর আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি জন্নবিছিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিণত হয়েছে। তাদের সাথে খেলা হবে নির্বাচনের মাঠে।
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এক জনসভায় বলেছেন, আমরা কখনো আওয়ামী লীগকে তাড়াতে চাইনি, ওনারাই দেশ থেকে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এসব কথার জবাবে আওয়ামী লীগের তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপিকে অনুরোধ করবো রাত-বিরাতে এদিক-সেদিক ঘুরে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।
সিঙ্গাপুর নয়, বাংলাদেশ এখন আজিমপুরের কাছাকাছি চলে গেছে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে একাই দেশ ত্যাগ করেছেন। আমাদের এখানে শুধুমাত্র একজনই দেশ ত্যাগ করবেন না। তাদের (আওয়ামী লীগের) উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই দেশ ত্যাগ করবে। তবে শ্রীলঙ্কার ঘটনা বাংলাদেশে ঘটবে এটা বলছি না। বাংলাদেশে যা ঘটবে তখন পৃথিবীর মানুষসহ শ্রীলঙ্কার ঘটনা সবাই ভুলে যাবে। কারণ অনেক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এ সরকার দিয়েছে। তারা বলেছিল, এদেশকে সিঙ্গাপুর বানাবে। এখন বাংলাদেশ আজিমপুরের কাছাকাছি।
গত বৃহস্পতিবার বিএনপিকে উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, রিমোর্ট কন্ট্রোলে ডাকা আন্দোলনে জনগণ সাড়া দেবে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাহস থাকলে দেশে এসে আন্দোলন করার আহ্বান জানান।
বিএনপি মহাসচিবের উদ্দেশে কাদের বলেন, ১৩ বছরে বোঝেননি? কত ডাক দিলেন, রোজার ঈদ, কোরবানির ঈদ, পরীক্ষার পর; আপনাদের ডাকে জনগণ কী সাড়া দিয়েছে। রিমোট কন্ট্রোলে ডাকা আন্দোলন এ দেশে হবে না। আন্দোলন যদি করতে চান, আপনাদের নেতাকে বলেন, সৎ সাহস থাকলে মাঠে আসুন, মাঠে মোকাবিলা হবে। খেলা হবে। সেখানেই দেখা যাবে জনগণ কার সঙ্গে আছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রসঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার মির্জা ফখরুল বলেন, ওবায়দুল কাদের বলেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কোনো ঘাটতি নেই। তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন, ঘাটতি নেই তো লোডশেডিং কেন? কেন তেল রেশনিং করছেন? জ্বালানি তেল রেশনিং করছেন, গ্যাস রেশনিং করছেন?
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ সম্প্রতি বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলেই তারা নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিচ্ছে না। বিএনপির সবকিছুতে না। সংসদ নির্বাচনে না, পৌরসভা নির্বাচনে না, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে না, সংলাপে না, সবকিছুতে না। আসলে তাদেরকে না ভূতে পেয়ে বসেছে। এই কারণে তাদের সবকিছুতে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ট্রেন কারও জন্য অপেক্ষা করে নাই, ট্রেনের পাদানিতে চড়ে বিএনপি নির্বাচনের ট্রেনে উঠেছিল ২০১৮ সালে। এবারও নির্বাচনের ট্রেন কারো জন্য অপেক্ষা করবে না।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর চায়ের দাওয়াত প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সেই চায়ের মধ্যে কী থাকবে- এটা জনগণের মধ্যে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের প্রশ্ন যে, বিরোধী দলকে ডেকে উনি কী খাওয়াবেন? সেই চায়ের মধ্যে ধুতুরার ফুল নাকি হেমলকের রস? প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি চায়ের দাওয়াত দিচ্ছেন। আমরা ঘেরাও করতে গেলে আপনি চা খাওয়াবেন। হঠাৎ আপনার গলার স্বর এভাবে নিম্নগামী হলো কেন? অদ্ভুত ব্যাপার। আপনার গলার স্বর যখন ক্ষীণ হয় তখন বুঝতে হয় বিরোধীদলের ওপর হয়তো আরো ভয়ঙ্কর নির্যাতন নিপীড়ন নেমে আসছে।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ