ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
আপনজন থেকেও নেই

দুঃখী মা-বাবাদের নিঃসঙ্গ ঈদ বৃদ্ধাশ্রমে

প্রকাশনার সময়: ১০ জুলাই ২০২২, ১১:০২ | আপডেট: ১০ জুলাই ২০২২, ১১:০৪

পঁচাত্তর বছর বয়সী মো: সেলিম চৌধুরী। ৭ বছর ধরে জীবন কাটছে বৃদ্ধাশ্রমে। ৩২ বছর শিক্ষকতা করেছেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুই কন্যা সন্তানের জনক তিনি। পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কেটেছে তার। দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলে সরকারি চাকরির ব্যবস্থাও করেন। বিয়ে দেন উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে। কিন্তু তখনও কঠিন জীবনের কথা জানতেন না সেলিম চৌধুরী।

২০১৩ সালে স্কুল থেকে অবসর নেয়ার পর হঠাৎ হার্নিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়েন তিনি। এই সুযোগে তার দুই মেয়ে চিকিৎসার কথা বলে সমস্ত জমানো টাকা-পয়সা কেড়ে নেয় এবং ডাক্তার দেখানোর কথা বলে ফেলে যায় চট্টগ্রামের বায়জিদ বোস্তামি মাজারে। প্রায় ১০ দিন মাজারের লোকজন খাবার দিয়ে যেতো। এরপর স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগীতায় তার ঠাঁই হয় ঢাকার বৃদ্ধাশ্রম ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’বৃদ্ধাশ্রমে।

এ বিষয়ে নয়া শতাব্দীর কথা হয় সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মেয়েরা কোনো খোঁজ খবর নেয়নি। ২০১৫ সালে বৃদ্ধাশ্রমে এসেছি। আমি এখানেই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চাই। কিন্তু পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। ঈদে মেয়েদের হাত ধরে কেনাকাটা করতে নিয়ে যেতাম। কত খুশিতে কাটতো আমাদের ঈদ। আমার স্ত্রী মারা যায় ২০১৪ সালে। অবসরে এসেছি ২০১২ সালে। মেয়েরা সব কেড়ে নিয়েছে।

শুধু সেলিম হোসেন নয়, এই বৃদ্ধাশ্রমে পরিবারহীন বাবা-মায়ের সংখ্যা ১৩৫ জন। শিশু রয়েছে ৩০ জন। তাদের সবার ঈদ কাটবে পরিবারহীন। যাদের সবাইকেই কুড়িয়ে আনা হয়েছে রাস্তা থেকে।

বৃদ্ধাশ্রমের কয়েকজন বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের জীবনের কষ্ট-দুঃখের কথা।

সালেমা আমজাদ (৮০)। ব্রিটিশ আমল থেকে পরিবারের সদস্যরা থাকতেন লন্ডনে। তার শৈশব-কৈশোর- পড়াশোনা আর বেড়ে উঠা সবই ওই শহরে। তারুণ্যের দিনগুলোও কেটেছে যুক্তরাজ্যের রাজধানীতেই। পরে বিয়ে, চার সন্তানের জননী হওয়া; সেও ওই লন্ডনে। জীবনের দীর্ঘ সময় স্বামী আর চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দময় জীবন কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে পৌছে ৭০ বছর বয়সী সালেমা আমজাদের ঠিকানা হয়েছে ঢাকার চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার বৃদ্ধাশ্রমে।

রাজধানীর কল্যাণপুরের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড কেয়ার সেন্টারে ৩ বছর বছর ধরে আছেন অবহেলিত এই মা। সেখানেই ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করে কাটাচ্ছেন তিনি দিনরাত। এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর সন্তানদের কেউ একবারের জন্যও তাকে দেখতে আসেননি। অথচ এই চার সন্তানকে বড় করে তুলতে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন সালেমা আমাজাদ।

সম্মানজনক বেতনের চাকরি পেয়েও সন্তানদের দেখভাল করতে গিয়ে তাতে যোগ দেওয়া হয়নি তার। পুরো সময়টায় সালেমা সন্তানদের দিয়েছেন। সন্তানরা ক্রমে বড় হয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে একপর্যায়ে খুব ভালো ভালো কাজের সুযোগ পান। চাকরিবাকরি, সংসার, সন্তানসহ নিজেদের মতো গুছিয়ে ফেলেন যার যার জীবন। শুধু তাদের কারো পরিবারেই জায়গা হয়নি বয়ষ্ক মা সালেমার। ছেলেমেয়ে সবার কাছেই তিনি থেকে গেছেন উপেক্ষিত। এখন বয়সের ভাড়ে নানা রোগে ভুগছেন তিনি। যে বয়সে ছেলে-মেয়ের যত্ন-ভালোবাসা পাওয়ার কথা সে বয়সে তাকে থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি বলেন, ওরা কেউ আমাকে দেখতে আসে না। ওদের জন্য আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যায়। অনেক কষ্ট হয়। এই কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না। ঈদের দিনগুলোতে তাদের আরও বেশি মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় পুরনো স্মৃতিগুলো।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (৭০)। বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চরকৈজুরী গ্রামে । পরিবারের ৩ ছেলেকে কুলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। জীবনের শেষ মুহুর্তে অসুস্থ হয়ে কাজ-কর্ম করতে না পারায় পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে যান তিনি। এক পর্যায়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তার স্ত্রী ও সন্তানরা। জীবনের শেষ বয়সে ঠাঁই হলো বৃদ্ধাশ্রমে।

বৃদ্ধাশ্রমের বদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে প্রিয় সন্তানের জন্য মুখ লুকিয়ে নিরবে ফেলছেন চোখের অশ্রু। তাদের অতীতের সুখ গল্পগুলো আঁকড়ে ধরে বুকে পাথর চেপে জীবন-যাপন করছেন এই অসহায় বাবা-মা। যাদের জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখকে বিসর্জন দিয়ে এসেছেন সন্তানের জন্য। সেই সন্তানদের ছাড়া বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলেও ভালো নেই বাবা-মা। বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্ব ভাবে জীবন কেটে যাচ্ছে তাদের। সন্তানদের জন্য বাবা-মায়ের বুক ফেটে গেলেও পাচ্ছেন না তাদের কোন ছোঁয়া। এই বাবা-মায়ের ঈদের আনন্দটাই যেন তাদের সন্তানবিহীন বৃদ্ধাশ্রমকে ঘিরে। অসহায় এই বাবা-মায়েরা নিজের অসহায়ত্বকে মেনে নিয়ে থাকতে চান জীবনের শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে। আবার অনেকে সব অভিমান ভুলে ফিরে যেতে চান সন্তানদের কাছে।

২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর রাজধানীর কল্যাণপুর দক্ষিণ পাইকপাড়ার চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার টি প্রতিষ্ঠা করেন মিল্টন সমাদ্দার। তিনি নয়া শতাব্দীকে জানান, বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মায়ের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এখন মোট ১৩৫ জন বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। এবং অসহায় প্রতিবন্ধী এতিম শিশু আছে ৩০ জন। করোনাকালে প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফেলে যাওয়ার খবর আসতো।

নয়াশতাব্দী/জেডআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ