পদ্মা সেতু বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক। কোনো মানুষ যখন সত্যটা সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারে না কিংবা পেছন থেকে মানুষের ক্ষতি করে তখন তাকে কথার ছলে আমরা অমেরুদণ্ডী বলে থাকি। তেমনই কোনো মানুষ যখন নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন হয় তখন তাকে আমরা মেরুদণ্ডবান মানুষ বলে থাকি। তদ্রূপ বিশ্বের পরাশক্তিরধর রাষ্ট্র আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস তদবির করিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক থেকে বন্ধ করার পরও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও সাহসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।
একইসঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় স্রোতবাহী নদীর বুকে পদ্মা এখন দাঁড়িয়ে আছে মেরুদণ্ডবান বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি রূপে। ইতোমধ্যেই বিশ্বের পরাশক্তিধর বিভিন্ন রাষ্ট্র অভিনন্দন জানাচ্ছে বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে তার এক ভাষণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লক্ষ করে বলেছিলেন, কবিগুরু বলেছিলেন— হে বঙ্গজননী, সাত কোটি সন্তানকে রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি, কবিগুরু এসে দেখে যাও— আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর কথার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে এখন হয়তো তারই কন্যার বলার সময় হয়েছে— মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এসে দেখে যাও— তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট নিজস্ব অর্থায়নে বানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পদ্মা সেতুকে ২০২৩ সালের জাতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ট্রামকার্ড হিসেবেই দেখছেন। এছাড়াও পদ্মা সেতু বিশ্বে শেখ হাসিনা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যে বহুগুণে বাড়িয়েছে সেটিও বলার অপেক্ষা রাখে না।
আকিব মুহাম্মদ ফুয়াদ: আমরা প্রথমেই যাব প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আকিব মুহাম্মদ ফুয়াদ, পড়াশোনা করছেন ঢাবির আইন বিভাগে। পদ্মা সেতু নিয়ে তার ভাবনা জানতে চাইলে নয়া শতাব্দীকে বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ নির্মাণের পূর্বেই দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ইন্ধনে বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম মোড়ল বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ওপর দুর্নীতির অভিযোগ এনে বাঙালি জাতিসত্তার ওপর চরম আঘাত হানে। তাদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু-পরিবার।
তখন স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে নিজেদের মনমাফিক নির্দেশনা দেয়ার স্পর্ধা দেখায় বিশ্বব্যাংক। তারা তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানের ওপর কোনো ধরনের আইনকে তোয়াক্কা না করেই কথিত দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেয়। যেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রনায়ক পরাজয়বরণ করেন, ঠিক সেখানেই ইস্পাত-দৃঢ়শক্তি নিয়ে তা মোকাবিলা করেন বঙ্গবন্ধুতনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি প্রমাণ করেন, সততা ও নৈতিকতার জোরে বিশ্বমোড়লদেরও চ্যালেঞ্জ জানানো যায়। পরবর্তীতে যখন দেশি-বিদেশি আদালতে প্রমাণ হয় আসলে কোনো দুর্নীতির ঘটনা ঘটেনি, বঙ্গবন্ধুতনয়া বিজয়ী রণযোদ্ধা হিসেবে বাঙালি জাতির মুকুটে পরিণত হন। এরপর শুরু হয় নতুন লড়াই, নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণের। এ যাত্রার অর্থনৈতিক লড়াইটা বাস্তবতার নিরিখে আরো কয়েকগুণ কঠিন। কিন্তু লড়াইটা ছিল লৌহমানবী শেখ হাসিনার একান্ত ব্যক্তিগত লড়াই, কারণ যে দেশ তার পিতা স্বাধীন করেছেন সে দেশের সক্ষমতার প্রশ্নে তিনি পিছু হটতে পারেন না। অবশেষে তিনি সফল।
সাওদা জামান রিশা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী সাওদা জামান রিশা। পদ্মা সেতু নিয়ে জানাতে চাইলে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, একটি প্রতীক যা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কাল পেরিয়ে আরো একবার বিশ্বের বুকে মাথা তুলে সগৌরবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে তা আপাতদৃষ্টিতে পদ্মা সেতু। আমার আছে ইতিহাস গর্বের, কখনোই ভয় করি নাকো উদ্যত কোন খর্গের, কবিতার লাইনটি অনেকবার পড়েছি— অনেক ইতিহাস শুনেছি এবার চাক্ষুস তা দেখার সুযোগ হলো। পদ্মা ওপারের মানুষদের জীবনের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তথা জিডিপিতে বৃহৎ অবদান রাখবে বলে বিশ্বাস করি। তবে পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনের লগ্নে ঠিক মুদ্রার অপর পিঠে থাকা বানভাসি মানুষের পাশে সবাই দাঁড়াই এবং ভবিষ্যতে এ দৃশ্য যাতে দেখতে না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাই। বাংলাদেশের উন্নয়নের রং কোনো জড়ায় ফিকে না হোক— বাংলাদেশের নাগরিক এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে আমার এই চাওয়া।
মো. সাকলাইন মোস্তাক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সাকলাইন মোস্তাক পদ্মা সেতু নিয়ে নিজের ভাবনা প্রকাশ করে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পদ্মা সেতু চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প।
ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর পর এটি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পর সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণের ২১টি জেলার সরাসরি সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লব সৃষ্টি করতে সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
রাজধানীসহ সারাদেশে কৃষিজ পণ্য সরবরাহে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের ওপর আমরা নির্ভরশীল। কাঁচামাল সরবরাহের জন্য প্রয়োজন দ্রুত যোগাযোগ মাধ্যম, কিন্তু বর্তমানে নদীপথ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম নেই। সুতরাং শাক-সবজিসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আদান-প্রদানে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
পদ্মা সেতু চালু হলে পরিবহন সময় প্রায় ৬ ঘণ্টা কমে আসবে এবং কোনো বাধা ছাড়াই পণ্য পরিবহন যাবে। এছাড়া সারাদেশ হতে বিভিন্ন রফতানিমুখী পণ্য পায়রা বন্দরে খুব সহজে ও কম খরচে পরিবহন করা সম্ভব হবে। এতে পণ্য রফতানির প্রবণতা বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে, জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বাড়বে।
এছাড়াও উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের আঞ্চলিক পণ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। যা স্বনির্ভরতা ও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া কুয়াকাটা, সুন্দরবনসহ দক্ষিণের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে যা পর্যটন বাণিজ্যে দেশকে আরো একধাপ এগিয়ে দেবে। ধারণা করা যায়, সেতুটি দেশের সামগ্রিক আয় ২.৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে।
হাজেরা সুলতানা : হাজেরা সুলতানা, পড়াশোনা করছেন ইডেন মহিলা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ। পদ্মা সেতু নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করে হাজেরা সুলতানা নয়া শতাব্দীকে বলেন, পদ্মা সেতু, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা। ৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকায় তৈরি ৪২টি পিলার বিশিষ্ট ১৫০ মিটারের এই সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
পদ্মা সেতু তৈরিতে দেশীয় উপাদানের ব্যবহার, নদী ব্যবস্থাপনার দিকে মনোনিবেশ, রিভার ট্রেইনিং ওয়ার্ক, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করার সক্ষমতা, জলবায়ু এবং জলজ জীবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে গুরুত্বারোপসহ অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো পদ্মা সেতুকে একটি মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যদি আমরা রেট অব রিটার্নের কথা ভাবি, এই পদ্মা সেতুর কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলা পুনরুজ্জীবিত হবে। শুধু যোগাযোগ বা পরিবহন ব্যবস্থার দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে। বিশেষভাবে, সেতুতে রেলসংযোগ এর কারণে পণ্য পরিবহন বা যাতায়াতই নয়, বরং আন্তর্জাতিক আমদানি-রফতানিতেও এর প্রভাব থাকবে। তবে সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দূরত্ব কমে যাওয়ার ফলে যেহেতু জ্বালানির খরচ এবং ব্যবহূত সময় কমবে তাই যাতায়াত খরচও কমবে। সেদিক থেকেও টোলের ব্যাপারটি বিবেচনা করা যায়। আমি আশাবাদী এই পদ্মা সেতু আমাদের দেশের জনজীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করবে।
রনো আনোয়ার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঔপন্যাসিক রনো আনোয়ার। তার কাছে পদ্মা সেতু নিয়ে তার ভাবনা জানতে চাইলে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা মানুষের নেতিবাচক দিকের সমালোচনা যেমন করি, ইতিবাচক মানসিকতার প্রশংসাও তেমনি জোরালো হওয়া উচিত। ক্রিকেটার রুবেলকে নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হয়েছে, তেমনি সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে বিপর্যস্ত সময়ে তিনি যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন জনগণের ফান্ড রেইজিংয়ের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার, সেই মানসিকতা প্রশংসিত হওয়া উচিত। এই যে নিজস্ব অর্থায়নের ধারণা, পদ্মা সেতু তার প্রথম নিদর্শন। যখন বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তখন দেশের শীর্ষ মিডিয়াগুলোর শিরোনাম ছিল— পদ্মা সেতু হচ্ছে না। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী চেয়েছিল যাতে পদ্মা সেতু না হয়। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, পদ্মা সেতু হবে নিজস্ব অর্থায়নে। আজ ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতুর।
কেউ বলেছিল— পদ্মা সেতু হবে না, কেউ বলেছিল— পদ্মা সেতু হবে জোড়াতালি মারা সেতু। আমরা জাতি হিসেবে খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারব না, যদি আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করতে না শিখি। আফসোস, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা এক হতে পারি না। এর চেয়ে বড় রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা আর নেই।
মাজহারুল ইসলাম শামীম: মাজহারুল ইসলাম শামীম। পড়াশোনা করছেন ফেনী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। পদ্মা সেতু নিয়ে জানতে চাইলে এ শিক্ষার্থী নয়া শতাব্দীকে বলেন, সব বিতর্ক, আবেগ ও উচ্ছ্বাসের কথা বাদ দিলেও পদ্মা সেতুর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে এবং জীবনযাত্রায় উন্নয়ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটা এ অঞ্চলের একুশ জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন তেমনি এ সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক-রেল দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন।
অর্থনীতিবিদরা মডেলিং করে হিসাব করেছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ২.৫ শতাংশ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে তখন দেশের জিডিপি বাড়বে অন্তত আরো ১.২৩ শতাংশ। ট্রান্স এশিয়ান রেল ও সড়ক এ সেতুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে। রেলের প্রভাবে জাতীয় জিডিপিতে আর এক শতাংশ যোগ হবে প্রতিবছর।
২০২৪ সাল নাগাদ ২৪ হাজার যান চলাচল করবে এ সেতু দিয়ে। প্রতিবছর তা বাড়বে। ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ৬৭ হাজারে উঠে যাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অংশ হিসেবেই সেতুর আশপাশে অনেকটা নদীর পাড় নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। যার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের দুয়ার খুলে যাবে। দেশের অর্থনীতিতেও তারা হয়তো বা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
তামান্না মুস্তারী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না মুস্তারী। পদ্মা সেতু নিয়ে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করে নয়া শতাব্দীকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম স্থাপনা পদ্মা সেতু। যা আমাদের জন্য গৌরবের। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে মোতাবেক আজ সেই ২৫ জুন, উদ্বোধন হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিটে নির্মিত এই সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
মেহেদী হাসান নিলয়: বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান নিলয়। পদ্মা সেতু নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করে নয়া শতাব্দীকে বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু কিংবা সম্ভাবনাময় পদ্মা সেতু; এমন নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করা হলেও আমার কাছে এই পদ্মা সেতু মানে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করার জায়গা। বাংলাদেশ যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারে, এই সক্ষমতাটুকু পুরো বিশ্ববাসীকে জানান দেয়ার প্রমাণ এই সেতু।
একজন তরুণ হিসেবে এর উত্তর আমিও খুঁজেছি। বিশ্বের সব থেকে স্রোতস্বিনী নদীগুলোর একটি আমাদের এই পদ্মা। যার তলদেশের বালি এবং মাটি ধুয়ে যাওয়ার পরিমাণও সর্বোচ্চ। একদিকে এর গড় গভীরতা যেখানে ৪০ মিটার, অন্যদিকে সেতুটি দৈর্ঘ্যে ৬.১৫ কিলোমিটার। নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, প্রায় ১৩ হাজার বাড়ি ভাঙা এবং ৭৪ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেয়া কোনো ছোটখাটো কর্মযজ্ঞ ছিল না। তবে নির্মাণ সময় যদি বৃদ্ধি করা না হতো তবে কিছুটা ব্যয় বোধহয় আমরা কমিয়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে নির্মাণ সময় বৃদ্ধি করা যেন এক ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে।
ইহ্তি শামুন: সরকারি বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইহ্তি শামুন। তার সঙ্গে কথা হয় পদ্মা সেতু নিয়ে, তিনি কিছুটা আবেগ-প্রবণ হয়েই নয়া শতাব্দীকে বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা রোগী এবং তার পরিবার জানে পদ্মা সেতু মানেই আশা। বাবার মৃত্যুর খবর শোনার পরও সময়মতো পৌঁছাতে না পারা ছেলেটার কাছে পদ্মা সেতু শেষ ভরসা। আমি ভোলার মেয়ে, সাধারণত নদীপথেই সর্বত্র চলাচল আমাদের। পদ্মার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়তো নই তবে সামান্য বৈরী আবহাওয়ায় অন্য সব জেলা থেকে যখন এই দ্বীপ জেলাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন মানুষের অসহায়ত্ব দেখতে হয়! যখন স্বপ্ন দেখি এই বিচ্ছিন্নতারও শেষ হবে একদিন, তখন আমার কাছে মনে হয় পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের মুক্তির দূত। এটা তো গেল প্রয়োজনের কথা, অর্থনৈতিক দিক থেকেও পদ্মা সেতুকে ঘিরে যেসব বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা চলছে সেটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য লাভজনকই হবে। তবে সেতু টোল নিয়ে যে নানান ধরনের কথা হচ্ছে, ট্রল হচ্ছে— সেক্ষেত্রে বলব, বাড়তি সুবিধা পেতে হলে একটু বাড়তি খরচ তো বহন করতেই হবে যেমনটা দ্রুত পৌঁছানোর তাগিদ বা আরামের জন্য লোকাল বাস ছেড়ে যখন আমরা সিটিং সার্ভিস বা এসিকে বেছে নেই।
মো. সাকিব: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সাকিব। তিনি পদ্মা সেতু নিয়ে নয়া শতাব্দীকে বলেন, বাংলাদেশের কোটি মানুষের স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। স্বপ্নের এই সেতু দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা বদলে দেয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা রাজধানী ঢাকার সঙ্গে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
এমনকি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে বিশ্বাস করি। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা পুরো বিশ্বে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও গৌরবান্বিত করেছে। বাঙালির আত্মনির্ভরশীলতার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুতনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
ফারিয়া জাহান : বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিয়া জাহান। আলাপচারিতায় তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, কার স্বপ্ন নয় আমাদের এই পদ্মা সেতু? যে সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি মানুষের অপার সম্ভাবনা।
বলার অপেক্ষা রাখে না এ সেতুর কারণে যারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে তাদের মধ্যে রয়েছি আমরা বরিশালবাসী। বরিশালের কৃষি, বাণিজ্য, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে এই পদ্মা সেতু। বাড়বে শিল্পক্ষেত্র ও পর্যটন কেন্দ্র।
মারুফ আহমেদ : সরকারি বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী মারুফ আহমেদ। পদ্মা সেতু নিয়ে নিজের ভাবনা প্রকাশ করে নয়া শতাব্দীকে বলেন, পদ্মা সেতু যেন ডেকে ডেকে বলছে— শত বাধা-বিপত্তি শেষে স্বপ্ন এসেছে বাস্তবে— ঘুম থেকে উঠো হে পদ্মা পারের অবহেলিত মানুষ।
তোমাদের দুঃস্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন নয়। এখন মাথা উঁচু করে বিশ্বকে দেখিয়ে দাও বাঙালি হারতে শেখেনি, যে বাঙালি স্বপ্ন দেখেই একটা মানচিত্র তৈরি করে সে বাঙালিকে হারাবার দুঃসাধ্য আছে কার? যার বাবার স্বপ্নে স্বাধীন বাঙলা— তার মেয়েকে হারাবার দুঃসাধ্য এ দুনিয়াতে আর কার আছে? হাঁটি হাঁটি করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই সোনার বাংলা। পদ্মার ঐ পারের মানুষগুলো আজ আর পিছিয়ে থাকবে না। পদ্মা সেতু ঘোরাবে তাদের ভাগ্যের চাকা।
মো. আসাদুজ্জামান আবীর: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আসাদুজ্জামান আবীর। তিনি পদ্মা সেতু নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে।
আরো বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠেছে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ