ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দখল-দূষণের উৎসব!

বুড়িগঙ্গা রক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও ফলশূন্য
প্রকাশনার সময়: ১০ জুন ২০২২, ০৮:২৩

ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বুড়িগঙ্গা এখন মৃতপ্রায়। দখলদূষণের উৎসব চলছে নদীর চারপাশ ঘিরে। নদী রক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও দিনশেষে ফলশূন্য! নদীর সীমানা থেকে ৩০-৪০ ফুট দূরে বালুমহাল তৈরি করার নিয়ম থাকলেও নিয়ম উপেক্ষা করে চলছে বালু ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম। বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষায় বারংবার বিভিন্ন সংগঠন অভিযোগপত্র জমা দিলেও মেলে না সুফল। অবশ্য মাঝে-মধ্যেই অভিযান পরিচালনা করে বিআইডব্লিউটিএ। অভিযানের পরদিনই আবারও একই পথ অনুসরণ করে নতুন জায়গা দখলে মাতে ভূমিদস্যুরা। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও ঢাকার খোলা জানালা হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা-প্রশাখার দুই তীরই কার্যত দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে, আস্তে আস্তে ঢাকার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বুড়িগঙ্গা। নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মাস্টারপ্লান করলেও বাস্তবায়নের কাজে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে অবৈধভাবে জমি দখল করে গড়ে তোলা সব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে নদী পুনঃখননেরও সিদ্ধান্ত নেন তারা।

নদী রক্ষা নিয়ে কাজ করেন এমন একটি সংস্থা নয়া শতাব্দীকে জানায়, দীর্ঘ দুই যুগ ধরে মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ কাঠা (৩৫০ একর) দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা, যার অনুমানিক বাজারমূল্য ৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সদরঘাটের আশপাশের দুই পাড়েই গড়ে উঠেছে শতাধিক স্থাপনা।

পরিবেশ সংগঠন ও নদী গবেষকরা বলছেন, বুড়িগঙ্গার পশ্চিমের শাখা নদীতে একসময় পালতোলা নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, ইঞ্জিন বোটসহ বড় বড় নৌযান চলাচল করত। স্রোতের কলধ্বনি এক থেকে দুই মাইল দূর থেকে শোনা যেত। অথচ তিন যুগ ধরে চলা দখলে বুড়িগঙ্গা এখন শীর্ণকায়। চকবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীচরের মধ্য দিয়ে গত শতকের মাঝামাঝিও বুড়িগঙ্গায় স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হতো। চারপাশের ভূমিদস্যুরা এ নদীর পেট কেটে দিন দিন ছোট করে ফেলছে। একটা সময় দেখা দিবে যেই বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে উঠা নগরী ঢাকাই থাকবে; কিন্তু বুড়িগঙ্গা থাকবে না। বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে হলে নদী আইন ও সরকারের মহলকে আরও শক্তিশালী হতে হবে।

সরেজমিনে বুড়িগঙ্গা পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর সীমানা পিলার ভিতরে দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র। বসিলা ব্রিজের ওপারে নদী থেকে মাটি তুলে রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বালু দিয়ে নদী ভরাট করার বিষয়ে স্থানীয় কয়েকজন কিছু চিহ্নিত ভূমিদস্যূর ইঙ্গিত দিলেও তাদের বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন স্থানীয় বাসিন্দা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ছোট কাল থেকেই বুড়িগঙ্গার পাড়ে আমার বসবাস। বুড়িগঙ্গার পূর্ণাঙ্গ যৌবন খুব কাছ থেকেই দেখেছি। অতীত বুড়িগঙ্গার যৌবন আর বর্তমান বুড়িগঙ্গার যৌবনের ভিতরে আকাশ পাতাল তফাৎ। ধলেশ্বরী হয়ে আসা বুড়িগঙ্গা নদী বেয়ে ঢেউ আসলে আমরা ঘরে বসে শুনতে পেতাম। এখন আর সেই ঢেউ নেই। বছিলা সেতুর অংশে বসিলা পুরোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন পিছনের অংশে সোজা একটা নদীর বহমান অবস্থিত ছিল; কিন্তু, এখন সেই বহমানতাকে ভূমিদস্যূরা ধীরে ধীরে গিলে খেয়ে ফেলছে। নদীর ভরাট করে ঘর বাড়ি করেছে।

তিনি বলেন, মাঝে মঝে বিআইডব্লিউটিএ এসে ড্রেজার মেশিন উল্টে রেখে গেলেও, মাত্র ঘণ্টাখানেক পর আবারও সেট করা শুরু করে। নতুন করে আবারও মাটি তুলে বিক্রি করা শুরু করেছে। এই বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারি না। কেননা, তাদের সাথে বড় বড় লোক জড়িত আছে। এখন যে হারে মাটি বিক্রি ও বালু তুলে ভরাট শুরু হয়েছে বেশিদিন লাগবে না বুড়িগঙ্গাকে গ্রাস করতে।

দু’পাড়ে সবুজ পরিবেশ ও স্বচ্ছ পানির বুড়িগঙ্গা আজ দৃষ্টিহীন হয়ে আছে। শুধু যে দখলেই বুড়িগঙ্গা মারা যাচ্ছে তা নয়, পাশাপাশি নদীর পানিকে বিষাক্ত করে মেরেও ফেলা হচ্ছে নদীকে। রিভার অ্যান্ড ডেলটা রেসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, বুড়িগঙ্গা নদীতে ওয়াসার ২৫১ টি সুয়ারেজ লাইন রয়েছে এবং নদীর ওপরে ২৩১ টি ডাস্টবিন রয়েছে। ঢাকায় প্রতিদিন উৎপাদিত ৪ হাজার ৫০০ কঠিন বর্জ্যের বেশিরভাগই চলে যায় বুড়িগঙ্গায়। ফলে স্বচ্ছ পানি ও দু’পাড়ে সবুজ পরিবেশে পরিবেশ প্রেমীদের গায়ে আবেগ মাখা বুড়িগঙ্গার ওপরে ঘন কালো অন্ধকার নেমেছে। অথচ নদীর দুই পাড় বেড়িবাঁধ থেকে বসিলা পর্যন্ত হাজার বিঘার জমির ওপর জীবিকা নির্বাহ করতো এলকার কৃষিজীবী সম্প্রদায়। দখলে দূষণে মেতে যাওয়ায় তাদের জীবিকায় ভাটা পড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বুড়িগঙ্গার আজ এমন অবস্থা। ২০০০ সাল থেকে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু, এখন পর্যন্ত আমরা নদীটিকে দূষণমুক্ত করতে পারিনি। বুড়িগঙ্গা যে কেবল শিল্প প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায় থেকে দখল ও দূষণ হচ্ছে তা কিন্তু নয়; রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও বুড়িগঙ্গার জায়গা লিজ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০০ সাল থেকে কোর্ট দখলদার উচ্ছেদের কথা বলে আসছে। আমরা দেখেছি, মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ হলেও আবার দখল হয়ে যায়। সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানই বুড়িগঙ্গার জায়গা দখল করেছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান দখলের পথ সুগম করেছে। অর্থাৎ জনগণের সম্পদ জনগণের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা অথবা ক্ষমতাসীনদের উদাসীনতা, অবহেলা, দুর্নীতি ও দুর্বলতার কারণে অন্যরা দখল করে নিয়েছে। রিভার অ্যান্ড ডেলটা রেসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ নয়া শতাব্দীকে বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী দখল হচ্ছে এটা বিষয়ে আমরা অবগত ঠিকই, কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেয়ার পরও কোনো ফলাফল আসেনি। বিআইডব্লিউটিএ মাঝে মাঝে অভিযান চালায় আবার যেমন তেমনই হয়ে যায়।

নয়া শতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ