ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

বন্দিশালায় ‘দ্বিগুণ’ চাপ

প্রকাশনার সময়: ০৩ মে ২০২৪, ০৭:০৯

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৮ কারাগারে আটক বন্দি রয়েছে ৭১২২৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৮৩১৫ জন এবং নারী ২৯১০ জন। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত্রে কারাগারে অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও বিএনপির মহাসচিব দাবি করেন দেশের কারাগারে ৬০ লাখ বিএনপির নেতাকর্মী আটক রয়েছেন।

তবে কারা সূত্রমতে, দেশের কারাগারগুলোতে মোট বন্দির ধারণ ক্ষমতা ৪২৮৬৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪০৯৩৭ ও নারী বন্দির ধারণক্ষমতা ১৯২৯ জন বলে কারাগার সূত্র দাবি করেছে। এমন পরিস্থিতে বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যে মিথ্যা বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ধারণক্ষমতা বেশি বন্দি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কারাকর্তৃপক্ষ। প্রচণ্ড গরমে সেবার মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নারী বন্দি নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষের। এমন পরিস্থিতে বন্দিদের সেবার মান নিশ্চিত করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। স্যালাইনের পানি সরবরাহ থেকে শুরু করে খাবারের মেন্যুতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। শরীর ঠান্ডা রাখে এমন ধরনের সবজি সরবারহ থেকে শুরু করে দুই বেলা গোসলের বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, চাপ থাকলেও তা সামলে নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি গরমে সেবার মানও নিশ্চিত করা হয়েছে। এ তাপপ্রবাহে বন্দিদের জন্য বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সার্বক্ষণিক চিকৎসকের উপস্থিতিও নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো বন্দি অসুস্থ বোধ করলেই তাকে তাৎক্ষণিক কারা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, পহেলা বৈশাখের আগে একটি অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব দাবি করেন দেশের কারাগারে ৬০ লাখ বিএনপির নেতাকর্মী আটক রয়েছে। তার এমন বক্তব্যের পর দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আটক বন্দিদের তালিকা চান। যদিও ওবায়দুল কাদের ২০ হাজার বন্দির কথা স্বীকার করেন। দুই দলের মহাসচিবের এমন বক্তব্যের পর অনুসন্ধানে নামে নয়া শতাব্দী। সেখানে দেখা গেছে কারাগারে মাত্র ৭১২২৫ জন বন্দি রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কারাগারের একাধিক উর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বললে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির মহাসচিব মিথ্যাচার করেছেন। কারণ দেশের কারাগারে মোট বন্দির ধারণক্ষমতা মাত্র ৪২৮৬৬ জন। তবে এ মুহূর্তে কারাগারে ধারণ ক্ষমতার বেশি বন্দি রয়েছে। যা নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। জানা গেছে, আগের তুলনায় কারাগারে সেবার মান বাড়ানো হয়েছে। নানা ধরনের অনিয়ম দুর্নীতিও বন্ধের পথে। তারপরও কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে প্রায়ই সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে বন্দির চাপ বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় জামিনের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ কারা কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি ও ঢাকা এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দির চাপ বেড়েছে। কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গি ও বিডিআর বিদ্রোহ মামলার আসামি রয়েছে। তাদের প্রতি বিশেষ নজরদারি চালানো হয় ২৪ ঘণ্টা। এর মধ্যে নতুন করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রায়ই আসামি পাঠানো হয় কাশিমপুর কারাগারে। কারণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও বন্দির চাপ রয়েছে।

কারা সূত্রে জানা যায়, বর্তমান দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগারে মোট ধারণ ক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪০৬৯৭ ও মহিলা ১৯২৯ জন। কিন্তু গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কারা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আটক বন্দির সংখ্যা ৭১ হাজার ২২৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৮৩১৫ ও মহিলা কারাবন্দি রয়েছে ২৯১০ জন। এর মধ্যে হাজতি রয়েছে ৫১ হাজার ৭৫৫ জন। এসব হাজতির মধ্যে পুরুশের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৬৯৬ ও মহিলা রয়েছেন ২০৫৯ জন। এছাড়া ১৯ হাজার ৪৭০ জন কয়েদির মধ্যে পুরুষ ১৮ হাজার ৬১৯ ও মহিলা ৮৫১ জন। এছাড়া বিদেশি বন্দি রয়েছে ৪৭২ জন। এদের মধ্যে হাজতি ২৭৮ জন ও কয়েদি ৫৫ জন। মহিলা রয়েছে ১৩৯ জন।

সূত্রমতে, কারাগারে আটক নারী বন্দিদের সঙ্গে রয়েছেন ৩৪১ জন শিশু। এর মধ্যে ছেলে ১৫৭ ও মেয়ে শিশু ১৮৪ জন। তাদের মায়েরা সাজাপ্রাপ্ত অথবা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বন্দি রয়েছে। শিশু হওয়ার কারণে তারা মায়ের সঙ্গেই কারাগারে থাকছেন। এছাড়া ঢাকা ও কাশিমপুর এবং নারায়গঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ৭৭৪ জন আসামি রয়েছে। তারা বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত। কারা সূত্রমতে, বর্তমান দেশের বিভিন্ন কারাগারে যুদ্ধাপরাধী রয়েছেন ১২৫ জন। এর মধ্যে হাজতি ৮৬, কয়েদি (সাজাপ্রাপ্ত) ১১ জন ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ২৮ জন। এছাড়া জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্য রয়েছে ৫৭৪ জন। এদের মধ্যে জেএমবির সংখ্যা ৪৩৩ ও অন্যান্য সংগঠনের জঙ্গি রয়েছে ১৪১।

জানা গেছে, ঢাকার আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গিদের মোবাইল ব্যবহারের তথ্য ফাঁস হয়। এরপর ঢাকার ডিআইজি প্রিজন ও কাশিমপুর কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারকে বদলি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হলে নড়েচড়ে বসে কারা কর্তৃপক্ষ। নজরদারি বাড়ানো হয় জঙ্গিদের ওপর। বসানো হয়েছে জ্যামার। তবে কারাগার থেকে অনুমোদিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারছেন বন্দিরা।

কারা সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে ৬৮ কারাগারের দায়িত্ব পালনের জন্য পুরুষ কারারক্ষী রয়েছেন আট হাজার ৫৬৫ জন এবং মহিলা কারারক্ষী মাত্র ৬১৭ জন। যা কারা নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত না। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কারারক্ষী নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় ১০ হাজার বন্দি রয়েছে। যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। একই অবস্থা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেও। কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ৪০০ বন্দির ধারণ ক্ষমতা থাকলেও সেখানে প্রায় ৯ শতাধিক বন্দি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কারাবন্দিরা। এরপরও কারাগারগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে আসামির সংখ্যা। এতে বন্দিদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেল কোর্ড অনুযায়ী আট বন্দির জন্য একজন কারারক্ষী ডিউটিতে থাকার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে এর চেয়েও বেশি বন্দির দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন কারারক্ষীর। দেশের কোনো বাহিনীর দৈনিক দুবার ডিউটি না থাকলেও কারারক্ষীদের রয়েছে দুই শিফটে ডিউটি। এ অতিরিক্ত ডিউটির জন্য নেই কোনো বাড়তি সুবিধা। এ ছাড়া কারাগারের ভেতরে নেই কোনো সেন্ট্রি পোস্ট। নেই কারারক্ষীদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা। এদিকে, জনবল সংকটের সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও সমাধানের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, কারাগারের লোকবলের কেউ কোনো অপরাধে জড়িয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পর আরও সংকট দেখা দেয়। আইনি কারণে তাদের পদগুলোতে নতুন লোক নেয়াও যায় না। অন্যদিকে জনবল সংকটে খালি থাকা বিভাগ ও পদগুলোর কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। কারাগারে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দিদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হচ্ছে নানামুখী সমস্যায়।

কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের সব কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা বাড়াতে এবং কারাগারকে প্রকৃত সংশোধনাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার। এরই অংশ হিসাবে সব পুরোনো কারাগার দ্বিতীয় স্থান হিসাবে ব্যবহার করা হবে। বন্দির মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা স্বার্থ সুরক্ষাই এ পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য। তবে নতুন জনবল নিয়োগ না করে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে গেলে পুরোনো জনবল দিয়ে কারাবন্দির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তবে প্রাথমিকভাবে সীমিত আকারে চালু করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে কারা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৬৮ কারাগারের জন্য সরকারের কাছে জনবল চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। কারারক্ষী ও কর্মকর্তাসহ ১০ হাজার ৮৫৬ জনের চাহিদার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ