সারা দেশের মহাসড়কের ৮৮৩ বাঁকে তৈরি হয়েছে মরণফাঁদ। আর ঈদযাত্রায় এসব বাঁকে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা। এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি এ ধরনের ৮৮৩টি বাঁক চিহ্নিত করে তা দ্রুত সোজা করার সুপারিশ করা হয়েছে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে। গত দশ বছরে মহাসড়কের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এসব বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
হাইওয়ে পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ৮৮৩টি বাঁকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬৪টি বাঁক রয়েছে দক্ষিণ বিভাগের মাদারীপুর রিজিওনে। এ রিজিওনের আওতায় রয়েছে মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, বরিশাল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুড়া, যশোর এবং নড়াইল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে বগুড়া রিজিওনে। এই রিজিয়নের বগুড়া, পঞ্চগড়, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট এবং গাইবান্ধার মহাসড়কে বিপজ্জনক বাক রয়েছে ২৪৮টি। এর বাইরে কুমিল্লা রিজিওনে ১৮১টি, সিলেট রিজিয়নে ১২৬টি এবং সবচেয়ে কম গাজীপুর রিজিওনের মহাসড়কের ৬৪টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দীন খান নয়া শতাব্দীকে বলেন, গত ১০ বছর ধরে দুর্ঘটনা তদন্ত করে এসব বাঁক বা মোড়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করে তা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তারা এসব বাঁকগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তী সীদ্ধান্ত নিবেন। পাশাপাশি চালক ও পথচারীদের সচেতন করতেও হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তবে কেবল সচেতনতার মাধ্যমেই মহাসড়কের বিপজ্জনক বাঁকগুলোর দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। তাদের মতে, সচেতনতার পাশাপাশি মহাসড়ককে বাঁকমুক্ত করতেও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া মহাসড়কে থ্রিহুইলার যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন যেন মহাসড়তে চলতে না পারে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নছিমন, করিমন ও ভটভটির মতো যানবাহনকে মহাসড়কে উঠলেই তা ডাম্পিংয়ে দেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, মহাসড়কের এসব বাঁকগুলো বছরের পর বছর আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বাঁক সোজা করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ বাঁকগুলো এখনো সোজা না করার কারণে দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। পাশাপাশি অনেক যানবাহনের ফিটনেস না থাকার পরও তারা মহাসড়কে বেপরোয়া। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই তদন্তে ফিটনেস ফেইলের তথ্য বেরিয়ে আসে। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন এই বিশেষজ্ঞ।
জানা গেছে, বরিশাল থেকে গৌরনদী পর্যন্ত ৩৫ কি.মি মহাসড়ক পারি দিতে একজন চালককে অতিক্রম করতে হয় চারটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এসব বাঁকে বিপরতী দিকের যানবাহনের অবস্থান চিহ্নিত করা যায় না। চালক যতক্ষণে বুঝতে পারেন, তার মধ্যেই ঘটে যায় প্রাণঘাতি দুর্ঘটনা। সারা দেশে এ ধরনের ৮৮৩টি বাঁক রয়েছে। মহাসড়কের দুর্ঘটনা রোধে নানা ধরণের কার্যক্রমের পাশাপাশি দুর্ঘটনাপ্রবণ বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করার কাজটিও করে থাকে হাইওয়ে পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশের তথ্য বলছে, বরিশাল-ভুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে অন্তত দুই ডজন। এর মধ্যে কাশিপুরের বন বিভাগ ও সমবায় ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তা, গড়িয়ারপাড়ের জননী পেট্রোলপাম্প ও কলাডেমা, ক্যাডেট কলেজ, রহমতাপুর সেতুর ঢাল, বিমানবন্দর মোড়, দোয়ারিকা ব্রিজের ঢাল, জয়েশ্রী, গৌরনদী প্রবেশপথ, বামরাইল স্কুলসংলগ্ন, বাটাজোর, আশুকাঠি, টরকি বাজার, কটকস্থল, বার্থি, ভুরঘাটা সেতুর আগে বিপজ্জনক সব বাঁক রয়েছে। বিপজ্জনক বাঁকগুলোর ঝুঁকি আরো বাড়িয়েছে অবৈধ যানবাহন। এসব যানবাহনই মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলেও মনে করে হাইওয়ে পুলিশ। গত এক বছরে সড়ক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সবচেয়ে বেশি জরিমানা আদায় হয়েছে মাদারীপুর রিজিওনে। এরপরই রয়েছে কুমিল্লা, গাজীপুর, সিলেট এবং বগুড়া।
ঢাকা-বরিশাল রুটে সাকুরা পরিবহনের চালক জমির উদ্দিন মোল্লা বলেন, এ মহাসড়কের বিপজ্জনক বেশ কয়েকটি বাক রয়েছে। বিশেষ করে বিমানবন্দরের বাঁক, জয়েশ্রী, আশুকাঠি, টরকি বাজার, বার্থি তারা শংকর মন্দির, ভুরঘাটাসহ এই রুটেই ২০ থেকে ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। এসব বাঁকের আগে দিননির্দেশনা সম্বলিত সাইনবোর্ড থাকলেও গতির কারণে তা খেয়াল করা যায় না। বাকগুলোতে দুটি পরিবহন মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত কেউ কাউকে দেখতে পারে না। নতুন চালকেরা অনেক সময় এসব বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ আগের তুলনায় বেড়েছে। বিপজ্জনক বাঁকগুলোতেও এখন দুর্ঘটনা আগের চেয়ে বেশি হচ্ছে বলে জানান এ গাড়িচালক।
যশোরের ট্রাকচালক মমিনউদ্দিন জানান, দেশের অন্য যে কোনো মহাসড়কের তুলনায় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মহাসড়কগুলো দুর্ঘটনা প্রবণ। কারণ এ মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। রাতে চলাচলের সময় এসব বাকে বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন দেখা যায় না। আবার অনেকক্ষেত্রে পরিবহণগুলো অতিরিক্ত গতিতে বাঁক অতিক্রমের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। এছাড়া ঢাকা-ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটটটির মতো অবৈধ গাড়ির চলাচল বেশি। এসব যানবাহনের জন্যও মহাসড়কটি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
সিলেট বিভাগের সঙ্গে সড়কপথে সারা দেশের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। প্রতিদিন এই মহাসড়ক দিয়ে কয়েক হাজার যানবাহন চলাচল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কের ৩৪ কিলোমিটার অংশ রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। আর এ ৩৪ কিলোমিটার অংশ দিন দিন মহাবিপজ্জনক হয়ে উঠেছে যাত্রীদের কাছে। রূপ নিচ্ছে আতঙ্কে। প্রতিবছরই এ সড়কে ঝরছে অনেক প্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অনেকেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩৪ কিলোমিটার অংশ পড়েছে আশুগঞ্জ, সরাইল ও বিজয়নগর উপজেলায়। ওই তিন উপজেলার অংশে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে ৮ থেকে ১০টি। এর মধ্যে আশুগঞ্জ গোলচত্বর, শাহবাজপুর তিতাস সেতু সংলগ্ন বাঁক, ভৈশামোড়া, রামপুরা, চান্দুরা, বীরপাশা ও ক্ষেতাবাড়ি এলাকার বাঁকগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বাঁক অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে রাতে এই মহাসড়কের বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটনা বেশি ঘটে।
মহাসড়কের দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু কার্যক্রম রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের। মহাসড়কের নিরাপত্তায় গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটের মূখপাত্র অতিরিক্ত ডিআইজি (এইচ আর এন্ড মিডিয়া) মো. শামসুল আলম বলেন, দশ বছরের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা মাহসড়কে বিপজ্জনক ৮৮৩টি বাক চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব বাকে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। বাঁকগুলো সম্পর্কে আশপাশের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনামূলক সভা করা হয়েছে। পাশাপাশি মহাসড়কের চলাচলকারী চালকদের নিয়েও সভা করা হয়েছে। সচেতনা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাঁকগুলোর দুর্ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা গেছে বলেও জানান তিনি।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ