আন্দোলনের ব্যর্থতা কাটিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়াতে চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার পাশাপাশি নিজেদের শক্তিরও জানান দিতে চায় দলটি। তবে কৌশল হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়া হবে না। স্থানীয়ভাবেই প্রার্থী হবেন দলটির নেতারা।
সূত্র জানায়, যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে জামায়াত। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন দলটির প্রার্থীরা। যেসব উপজেলায় জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে ইতোমধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাকি উপজেলাগুলোতেও প্রার্থী প্রস্তত রাখা হয়েছে। যেহেতু দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে তাই স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন জামায়াত নেতারা।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে জামায়াত এখনো কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সিদ্ধান্ত হলে জানতে পারবেন।’
জানা গেছে, এবার উপজেলা নির্বাচন চার ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৮ মে। তার আগে মনোনয়নপত্র জমা ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত, যাচাই-বাছাই ১৭ এপ্রিল, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ২২ এপ্রিল এবং প্রতীক বরাদ্দ ২৩ এপ্রিল।
এছাড়া দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী আগামী ২১ মে ভোটগ্রহণ করা হবে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় নির্বাচন হবে সেখানে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২১ এপ্রিল। মনোনয়ন বাছাই হবে ২৩ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ৩০ এপ্রিল। ভোট গ্রহণ ২১ মে।
জামায়ত সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর একে একে জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ মুক্তি পাচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনের পর জামিন পাওয়া নেতাদের আগের মতো জেলগেট থেকে ফের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। জামায়াত নেতারা জানান, নির্বাচনের পর জামায়াত ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে রয়েছে। শিক্ষায় নৈরাজ্য, জ্বালানি সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এছাড়া রমজান মাসে ইফতার মাহফিল কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সরব হচ্ছেন দলটির নেতারা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইফতারেও অংশ নিচ্ছেন তারা।
এদিকে প্রায় ৯ বছর পর প্রকাশ্যে রাজধানীতে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত শনিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এ ইফতারের আয়োজন করা হয়। ইফতারে বিএনপিসহ সমমনা মিত্র রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। এর আগে ২০১৫ সালে প্রকাশ্যে জামায়াত ইফতারের আয়োজন করেছিল। সেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাজনীতিকদের সম্মানে রাজধানীর লেডিস ক্লাবে অনুষ্ঠিত বিএনপির ইফতার মাহফিলে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ছাড়াও দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিমসহ চারজন অংশ নেন। তবে গত বছরের ইফতারে জামায়াতকে আমন্ত্রণ জানায়নি বিএনপি। তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের দুই শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেউ অংশ নেয়নি।
গুঞ্জন রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাত রয়েছে। এ জন্যই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর জামায়াতকে ছাড় দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু সরকারের সঙ্গে আপস বা আঁতাত নেই জানিয়ে জামায়াত নেতারা বলেছেন, আন্দোলনের কর্মসূচি না থাকায় ছাড় দেয়া হচ্ছে।
জামায়াতের এক নেতা বলেন, বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। উপজেলা নির্বাচনে যেহেতু দলীয় প্রতীক না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চায় দলটি। সব উপজেলায় প্রার্থী ঠিক করা হলেও যেসব স্থানে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে ইতোমধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে এ প্রার্থী ঘোষণা করা হবে না। স্থানীয় জামায়াত নেতারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের অংশ নেয়ার বিষয়ে বিএনপি কোনো আপত্তি জানালে সেই ক্ষেত্রে নির্বাচন থেকে পিছু হটতে পারে দলটি।
গত শনিবার ইফতার মাহফিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উদ্দেশে জামায়াতে আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘ক্ষমতায় যারা আছেন আমরা তাদের দুশমন নই, একই রক্ত। হজরত আদম-হাওয়ার (আ.) রক্ত আমাদের সবার শরীরে। আমরা তাদেরও কল্যাণ কামনা করি। আমরা সবাইকে সত্যের পথে আসতে বলি। হঠকারিতার পথ পরিহার করতে বলি। যদি এ ডাকে কেউ সাড়া দেয়, তাকে মোবারকবাদ।’ তিনি বলেন, ‘সত্যের পক্ষে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। সে দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে আমার ওপর যদি কোনো আঘাত আসে, তাহলে এর প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করার অধিকার আমার আছে। আমরা কারও সঙ্গে গায়ে পড়ে লাগতে চাই না। কিন্তু কেউ যদি পায়ে পাড়া দিয়ে আমার সঙ্গে বাধে, তখন তো আমার দায়িত্বটা আমাকে পালন করতেই হবে। হঠকারিতা নয়, বিশৃঙ্খলা নয়, সত্যের পক্ষে বুক সটান (উঁচিয়ে) করে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আমরা রাজনীতি করি, এটা আমাদের অপরাধ নয়। সরকারি দলের লোকেরা যদি রাজনীতি করার অধিকার রাখে, আমাদের প্রত্যেকটি নাগরিক সাংবিধানিক অধিকার বলেই রাজনীতি করার অধিকার রাখে।’
জানা গেছে, শরীয়তপুরে উপজেলা নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যে দুই জন প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে জামায়াত। তারা হলেন-ডামুড্যা উপজেলায় মো. ইলিয়াছুর রহমান এবং সদর উপজেলায় মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম।
মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘দুইটি উপজেলায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাকি উপজেলাগুলোতেও প্রার্থী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমরা অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর জেলার আটটি উপজেলায় প্রার্থী ঠিক করেছে জামায়াত। এর মধ্যে সদরে চেয়ারম্যান পদে জেলা জামায়াতে ইসলামী শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আবুল হাসিম রেজা ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে সহকারী সেক্রেটারি শামছুজ্জামানকে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সবশেষ ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামায়াতের শতাধিক প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলাসহ) হন। এর আগে ২০০৯ সালের নির্বাচনে ২৪ উপজেলায় চেয়ারম্যানসহ ৩৯ জন ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলাসহ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত। দলের নিবন্ধন না থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল জামায়াত নেতাদের। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তে সেবার কেউ নির্বাচনে অংশ নেননি।
নয়া শতাব্দী /আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ