ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজধানীজুড়ে বাজার!

প্রকাশনার সময়: ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩২

ফুটপাত থেকে ফুট ওভারব্রিজ, শপিংমল থেকে মহল্লার অলিগলি রাজধানী ঢাকার প্রায় সব সড়কে ভাসমান বাজারের দেখা মেলে। মূল সড়কের দুই পাশের সড়কজুড়েও প্রতিনিয়ত বসছে ভাসমান বাজার। আর এসব বাজারের বে-আইনি দোকানগুলোতে রয়েছে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ।

আছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। এর জন্য হচ্ছে তীব্র যানজট। ফলে পথচারীসহ যানবাহনকে হরহামেশা নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। স্থানীয়দের অভিযোগও কম নয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করছেন।

জানা গেছে, অননুমোদিত এসব ভাসমান বাজারে থাকা দোকানিদের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে মোটা অঙ্কের চাঁদা পায় স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় অসাধু ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা একটি প্রভাবশালী মহল। ফলে নানা অভিযোগ থাকার পরও এসব বাজার বা দোকান সরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভাসমান এসব দোকান বা নিয়মিত বাজার বসানোর কারণে নগরীজুড়ে যানজটের তীব্রতা আরও বেড়ে যাচ্ছে।

মাংস, ইলিশ মাছ বা পানিতে সাঁতার কাটার দৃশ্য দেখে রুই-কাতল কিনবেন; আপনি যেতে পারেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের ব্যস্ত সড়কে। সবজি কিনবেন, চলে যান বঙ্গভবনের উত্তর দিকে দিলকুশার ব্যাংকপাড়ায়। তরতাজা দেশি মাছ কিনবেন; যেতে পারেন মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে। সবকিছুই পাবেন। এখন আর সবজি-ফলমূল-মাছ-মাংস কিনতে নির্দিষ্ট বাজারে যেতে হয় না।

ব্যাংক পাড়া হিসেবে পরিচিত জনাকীর্ণ এবং ব্যস্ত হিসেবে পরিচিত মতিঝিল ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা বাজারে সবকিছুই পাবেন। এভাবেই খিলক্ষেত, মিরপুর, শান্তিনগর, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, মহাখালী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, আজিমপুরসহ রাজধানীজুড়েই বসছে বাজার।

সড়ক যোগাযোগ তথা চলাচলের ক্ষেত্রে এ ধরনের বাজার চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করলেও সংশ্লিষ্টদের এ নিয়ে যেন কিছুই যায় আসে না। সমাধানে নেই কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ।

মতিঝিল এলাকা থেকে কেনাকাটা করেন আবুল হোসেন শাকিল। তিনি বলেন, মতিঝিল এলাকায় এখন সব জিনিসপত্র পাওয়া যায়। মাছ, তরকারি থেকে শুরু করে, হাড়ি পাতিল, কাপড়-চোপড় সবই পাওয়া যায়। মার্কেটে যাওয়ার ঝামেলা নেই, তাই এখান থেকেই কিনে ফেলি। কিন্তু এ এলাকায় ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে আরও নিরাপত্তার জন্য ফুটপাতের ভিড় বা বাজার কমানো দরকার।

সরেজমিনে দেখা যায়, নির্ধারিত কেনাবেচার জায়গা, মার্কেট, শপিংমলের পাশাপাশি মানুষ চলাচলের ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজ ও গাড়ি চলাচলের সড়কও বাজারে পরিণত হয়েছে। সব খানেই বিক্রি হয় জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।

এসব স্থানে ক্রেতাদের আগমন বা আগ্রহ কম নয়। রাজধানীর সব সড়ক ও অলিগলিতে এ ধরনের ভাসমান দোকান বা নিয়মিত বাজার বসানোর কারণে যানজটের তীব্রতাও বাড়ছে। অফিস শুরু বা ছুটি হলেই ভয়াবহ যানজট হয়।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, রাজধানীতে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সড়কগুলো দখল মুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সবাইকে তৎপর হতে হবে। রাস্তার মোড়গুলোতে গাড়ি যেন আটকা না পড়ে সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পুলিশকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। সড়ক ও ফুটপাতগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে।

রাজধানীর খিলক্ষেত, গুলিস্তান, পল্টন, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এ্যালিফ্যান্ট রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা কলেজের সামনে, গাউসিয়া মার্কেট এলাকা, ফার্মগেট, মিরপুর, উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মৌচাক, খিলগাঁও, মহাখালী, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকার বংশাল, নবাবপুর এলাকায় নিয়মিতই ফুটপাত ও ফুট ওভারব্রিজে শতশত দোকান বসে।

হাজার হাজার মানুষ এসব দোকানে কেনাকাটা করেন। রাতের বেলায় অধিকাংশ দোকানে বেশি বেচাকেনা হয়। আর এসব দোকানে রাস্তার পাশের বিদ্যুতের খুঁটি থেকে বিদ্যুতের লাইন নামিয়ে অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সড়কে এবং গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও বৃহদাকার বিল্ডিংয়ের সামনে অবৈধ দোকান থেকে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য ও স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করেন এমন অনেকেই জানান, তারা নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে পণ্য নিয়ে বসেন।

বিকেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্ধারিত লাইন্সম্যান এসে দিনের চাঁদা নিয়ে যায়। শুধু তাই নয় মাসেও তাদের মোটা অঙ্কের ভাড়া গুনতে হয়। মাঝে মাঝে এলাকার থানার ওসি বদল হলে নতুন ওসি এসে দোকান তুলে দেয়ার অভিযান করেন। তখন তাকে আগের মতো চাঁদা দেয়ার মাধ্যম দোকান বসিয়ে আগের মতোই ব্যবসা করা হয়। ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে টম জেরির খেলা হয়েছে। অনেক দোকান রাস্তা থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরের দিনই সেই দোকান সড়ক দখল করে বসেছে।

ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে মুখরিত ফুটপাত দেখে বোঝার উপায়ই নেই এটি পথচারীদের হাঁটার জায়গা। তবে শুধু ফুটপাত নয়, ফুট ওভারব্রিজ, শহরের অলিগলিজুড়েই আছে দোকান, মোড়ে মোড়ে, বড় রাস্তার পাশে বহুতল মার্কেট-বিপণিবিতান যেন পুরো ঢাকাই একটা বাজার।

রাজধানী শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ঘুরে দেখা যায়, যেখানেই মানুষের সমাগম, সেখানেই গড়ে উঠেছে বাজার। ঢাকা এখন মসজিদের শহরের পাশাপাশি নাম ধারণ করছে বাজারের শহর হিসেবে। আর এসব বাজার চলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। কোনো কোনো এলাকা আবার রাত যত গভীর হয় বাজার তত জমজমাট হয়। শহরের কোনো জায়গা খোলা থাকলেই সেখানে বসে পড়ে দোকানপাট। একটা দোকান বসার পর থেকে তার দেখাদেখি বসতে শুরু করে শতশত দোকান।

এর পর থেকে ওই এলাকাই একটি বাজারে পরিণত করে। আর এ অস্থায়ী বাজার এক পর্যায়ে স্থায়ী রূপ নেয়। এসব বাজার শুধু ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এসব বাজার ঘিরে গড়ে ওঠে বিশাল অঙ্কের সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে থাকেন সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতারা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি আখতার মাহমুদ বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক বাজার থাকার কথা থাকলেও প্রতিটি ওয়ার্ডে বাজার নেই। এ কারণে বিক্রেতারা দখল করছেন ফুটপাত। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্যে আসা উচিত। যেভাবে বাজার গড়ে উঠছে ফুটপাতে, এটা কোনো পরিকল্পনামাফিক চলা রাজধানীর চিত্র হতে পারে না।

হকারদের পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের এমন জায়গায় পুনর্বাসন করতে হবে, যেখানে সহজেই কেনাকাটা করতে মানুষ যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে কোনোভাবেই হকারদের বসতে দেয়া যাবে না।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান এলাকা। এখানে পাওয়া যায় না এমন কোনো জিনিস নেই। এখানেই রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কয়েকটি মার্কেট। এছাড়া এখানে রাস্তার ওপরই বিক্রি হয় নানা পণ্য। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে এ জায়গা থাকে সব সময় মুখর। রাস্তার পাশে ও ফুটপাতে দোকানের কারণে প্রতিদিনই এই এলাকায় যানজট লেগেই থাকে।

গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের পাশের গলিতে, ফুলবাড়িয়া ফ্লাইওভারের নিচে, স্টেডিয়ামের অপরদিকের রাস্তায় এবং সদরঘাট, ভিক্টোরিয়া পার্ক ও লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সড়ক ও ফুটপাত হকারদের অভয়ারণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক’দিন পরপরই এসব জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। উচ্ছেদের পর আবার বসে পড়েন হকাররা। এখানেই প্রতিনিয়তই দেখা যায় হকার-পুলিশ খেলা।

ঢাকার প্রবেশপথগুলোর একটি যাত্রাবাড়ী এলাকা। এখানে ফ্লাইওভারের নিচে সকাল থেকে প্রায় সারা দিনই বসে মাছের বাজার। সড়কের ওপরে মাছের বাজার বসার করণে দূরপাল্লার বাসগুলো ঢাকা থেকে বের হতে ও প্রবেশ করতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এছাড়া সায়েদাবাদ ও ফ্লাইওভারের নিচ সব এলাকায়ই বসে বাজার। আরামবাগ-ফকিরাপুল, গুলিস্তান, নিউমার্কট একাধিক স্পটে সড়কের ওপরই বসে বাজার। ঢাকা কলেজের সামনে বাসে নিয়মিত কাপড়ের পাইকারি ও খুচরা বাজার।

খিলক্ষেত ও নিকুঞ্জ-২ এলাকার বিভিন্ন মূল সড়কের দুই ধার দখল করে বসানো হয় বাজার। এছাড়া খিলক্ষেতের ফুটওভারে এসব দোকানিদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি যেন সন্ধ্যার পর পথচারীদের চলাচলই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এছাড়া এলাকায় সড়কের দুই পাশে বসে কাপড়সহ নিত্যপণের বাজার। এসব দোকানের কারণে পথচারীকে চলতে হয় রাস্তার ওপর দিয়ে।

এসব সড়কের অনেক স্থানেই আবার ফুটপাতও নেই। এলাকার বেশ কয়েকটি অলিগলি সড়কে বসানো হয়েছে দোকান। ফলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব এলাকার সড়কে লেগে থাকে যানজট।

উত্তরায় সড়ক দখল করে বসানো হয় বাজার। বিমানবন্দর-গাজীপুর মহাসড়কের উত্তরা এলাকায় সড়কের দুই পাশে বসে কাপড়সহ নিত্যপণের বাজার। এসব দোকানের কারণে পথচারীকে চলতে হয় রাস্তার ওপর দিয়ে। এসব এলাকার ফুটপাতগুলো দখল করে দীর্ঘদিন ধরেই বসানো হয়েছে দোকান। মূল সড়কের বাইরেও আজমপুরসহ উত্তরার বেশকয়েকটি এলাকায় অলিগলি সড়কে বসানো হয়েছে দোকান। মতো সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব এলাকায় লেগে থাকে যানজট।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ফুটপাতে যারা ব্যবসা করেন তাদের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসতে দিতে হবে। যাতে তারা সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবসা করতে পারেন। ফুটপাত হাঁটার জন্য তাই মানুষের চলাচলের জায়গা ঠিক রাখতে হবে।

তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা যাবে না। একেক পক্ষ তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। এটা বন্ধ করতে হবে। সুশৃঙ্খলভাবে যাতে তারা ব্যবসা করতে পারেন তাদের সেই সুযোগ দিতে হবে। যেখানেই হোক একটা নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে দিতে হবে। নির্ধারিত জায়গায় ক্রেতারা সেখানে যাবেন। তাহলে ফুটপাতে শৃঙ্খলা আসবে।

ঢাকা শহরে সারা বছর যানজট লেগে থাকলেও আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে এসব দোকানিদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে প্রধান সড়ক, অলিগলি, ফুটওভারব্রিজ, ফুটপাত ও শপিংমলগুলোর আশপাশে। এ কারণে ক্রমেই জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে।

গোটা নগরের যোগাযোগব্যবস্থা থমকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আসন্ন রমজানে রোজাদার যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ত্রাহি অবস্থায় পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সড়কের মধ্যে এমন দোকানপাটে দায় নিচ্ছে না কেউ। নগরের প্রধান সড়ক সহ অলিগলি, ফুটপাত ও ফুট ওভারব্রিজজুড়ে দখল করে কেন এসব বাজার হবে, এমন প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ