ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় গত চার মাসে মশার ঘনত্ব দিগুণেরও বেশি বেড়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, উত্তর সিটির দক্ষিণখান, উত্তরার দুটি স্থান ও মিরপুর এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মশা পর্যবেক্ষণ করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটি গবেষক দল।
সবচেয়ে বেশি মশার ঘনত্ব মিলেছে উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায়। মশার ফাঁদ পেতে এ গবেষণা চালানো হচ্ছে। এতে ৯৯ শতাংশ ধরা পড়ছে কিউলেক্স মশা। বাকি ১ শতাংশ এডিস, এনোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয়া। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার।
গবেষণায় দেখা গেছে, নভেম্বরে গড়ে ২০০টি করে মশা ধরা পড়ত সব ফাঁদে। ডিসেম্বরেও গড় সংখ্যা মোটামুটি একই থাকে। তবে জানুয়ারি থেকে এ সংখ্যা ৩০০ হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারিতে ৩৮৮ ও চলতি মার্চে এই সংখ্যা ৪২০টিতে ঠেকেছে।
অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেছেন, মশার ঘনত্ব জানতে মূলত এ গবেষণা। এর আগে পূর্বাভাসে আমরা বলেছিলাম মার্চে চরমে পৌঁছাতে পারে। সেই পূর্বাভাস সত্যি হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে প্রতি ফাঁদে মিলছে ৪২০টি মশা। সবচেয়ে বেশি মশা পাওয়া যাচ্ছে উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায়। গড়ে ৫০০ মশা ধরা পড়েছে।
কবিরুল বাশার বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৪টি প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। এ মশা সাধারণত পচা পানিতে হয়। তিনি বলেন, মশা যে শুধু ঢাকায় বাড়ছে তা নয়। সারা দেশে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি না হয়, কিউলেক্স মশার উপদ্রব বাড়তে থাকবে।
এদিকে চলতি বছর শুরুর দুই মাসেই ডেঙ্গুজ্বরে প্রাণ গেছে ২০ জনের। যা গত বছরের এ সময়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঠিকঠাক মশা নিধন না করলে এবার পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। ভেঙে যেতে পারে গত বছরের প্রাণহানির রেকর্ড। এ অবস্থায় প্রয়োজন জোর প্রস্তুতি।
এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছরের প্রস্তুতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ে অত্যন্ত সজাগ আছি। ইতোমধ্যে একটি মিটিংয়ের আহ্বান জানিয়েছি, যেখানে শহরের দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সবাই থাকবে। এ মিটিংটি অতিসত্বরই হবে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বছরে শতকোটি টাকার বেশি খরচ হলেও নগরবাসী মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না। মশা মারায় খরচ বাড়লেও মশা কমে না। নগরবাসীর অভিযোগ, এর কারণ সিটি করপোরেশনের গাফিলতি, কার্যকরী ওষুধ ব্যবহার না করা, ঠিকমতো ওষুধ না ছিটানো ও মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে না পারা। মানুষের সচেতনতার অভাবও একটা কারণ।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, সিটি করপোরেশনের যত ওয়ার্ড রয়েছে, ওই ওয়ার্ডগুলো যদি ভাগ করা হয় যেমন: উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, মধ্য ঝুঁকিপূর্ণ, নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকি নেই। অতএব, এই ৪টি ভাগে ভাগ করলে; উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ যেসব এলাকা, সেসব জায়গায় প্রচুর কাজ করতে হবে। মধ্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়ও অনেক কাজ করতে হবে। নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোয় একটু কম কাজ করলেও হবে।
এদিকে আইইডিসিআর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, মশক নিধন খুবই দরকার এবং সেটা সামগ্রিকভাবে পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গ্রামে, মহল্লায়-মহল্লায় মানুষকে সম্পৃক্ত করে আমাদের পরিবেশকে পরিছন্ন করতে হবে। এছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা তো আছেই; স্তরভিত্তিক বিন্যাস ও কেন্দ্রীভূত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনে আলাদা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের কর্মসূচি তেমন কার্যকরী নয়। ফলে নগরীর মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ থাকে। আবার ডেঙ্গু মৌসুমে হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। গত বছরও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন। আর ঢাকার বাইরে ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। গত বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১ হাজার ৭০৫ জন। ঢাকায় ৯৮০ জন ও ঢাকার বাইরে ৭২৫ জন। এ হিসাব হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের। তাদের বাইরে কয়েক লাখ লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে থেকে ও চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছে। এর হিসাব সরকারি দপ্তরে থাকে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘এখানে যে ওষুধ ছিটানো হয় সেটি কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করে জানা দরকার। কার্যকর ওষুধ আমদানি করা দরকার। ওষুধ ঠিকমতো ছিটানো হয় কিনা, তার তদারকি দরকার। সিটি করপোরেশনের তদারকি কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মানুষকে সংযুক্ত করা দরকার। তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে ওষুধ ঠিকমতো ছিটানো হয় কিনা।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় সিটি করপোরেশনের মশককর্মীরা রাস্তায় ওষুধ ছিটায়। মশা কিন্তু রাস্তায় থাকে না। মশা থাকে বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে, ড্রেনে, ময়লার স্তূপে ও যেসব জায়গায় পানি জমে সেখানে। এসব জায়গা স্থানীয়দের সহায়তা চিহ্নিত করে ওষুধ ছিটাতে হবে। মশানিধনে তিনটি কথা মনে রাখা জরুরি ঠিক ওষুধ, ঠিক সময় ও ঠিকমতো ছিটানো।’
নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মশার উৎপাত বেড়েছে। মানুষ মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে নিজেরাই কীটনাশক স্প্রে, মশার কয়েল ও মশারি ব্যবহার করছে। তারা মশানিধন কার্যক্রম বাড়াতে সিটি করপোরেশনের প্রতি আহ্বান জানান।
রাজধানীর খিলক্ষেত উত্তর নামাপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী কাইউম হোসেন বলেন, ‘এই এলাকায় মশার উৎপাত অনেক বেড়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের মশককর্মীদের ওষুধ ছিটাতে দেখা যাচ্ছে না।’
রাজধানীর পোস্তগোলার বাসিন্দা শাফনাজ ইসলাম জানান, তার পরিবারের সদস্যরা চারতলায় থাকেন। তার ফ্ল্যাটসহ আশপাশের এলাকায় প্রচুর মশা। সামনে ডেঙ্গুর মৌসুম। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
মিরপুর কালশি ডি ব্লকের বাসিন্দা খাঁন মো. এনায়েত বলেন, মিরপুরে মশা আছে, তবে অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম। সামনে বৃষ্টির মৌসুম। মশা বাড়বে। সিটি করপোরেশনের ওষুধ ছিটানো আরও বাড়ানো দরকার।
দক্ষিণখানের বাসিন্দা গোলাম সাত্তার বলেন, এ এলাকায় প্রচুর মশা। মানুষ মশার কয়েল, ইলেকট্রিক ব্যাট, স্প্রে ও মশারি ব্যবহার করছে। তার এলাকায় এক মাসেও সিটি করপোরেশনের মশককর্মীদের মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি। তিনি মশকনিধন কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র জানায়, গত রবিবার ডিএসসিসিতে মশা মারার বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস মশা নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। মশার প্রজননক্ষেত্র খোঁজ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১০টি অঞ্চল রয়েছে। এসব অঞ্চলে ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। মশানিধনে ১ হাজার ৫০ জনবল কাজ করছে। মশানিধনে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু মশার আক্রমণ থেকে মানুষ রেহাই পাচ্ছে না।
ডিএসসিসির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশিরুল হক ভুঞা বলেন, মশা নিধন কার্যক্রম সারা বছরই চলে। প্রয়োজনীয় ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তিনটি স্থানে ফিল্ড পরীক্ষা শেষে ওষুধ ছিটানো হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘এখন কিউলেক্স মশা বেশি হয়ে থাকে। মশার বিস্তার কমাতে আমাদের মশা নিধনকর্মীরা কাজ করছে। আমাদের ৭৫ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিং ও দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত অ্যাডালটিসাইডিং ওষুধ ছিটানো হয়। মশার বংশবিস্তার কমাতে খাল, ডোবা, নালা, ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে। আমাদের কাজের কারণে এ বছর মশা অনেক কম।’ তিনি বলেন, ‘সামনে ডেঙ্গুর মৌসুম। আমরা সতর্ক আছি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত। এসব অঞ্চলে মোট ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। ডিএনসিসিতে মশা নিধনে গত অর্থবছরে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।
কীটতত্ত্ববিদ নেই সিটি করপোরেশনে: মশা নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কীটতত্ত্ববিদরা। শহরের কোথায় মশার প্রজননস্থল তৈরি হয়েছে এবং সেখানে মশা নিধনে কী কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার তা নিয়মিত ইনস্পেকশন করে প্রতিবেদন দেন করপোরেশনের কীটতত্ত্ববিদরা। তার ওপর ভিত্তি করেই করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু উত্তর সিটি করপোরেশনে একজন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থাকলেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। ফলে মশার প্রজননক্ষেত্র বা উৎপত্তিস্থল অজানা থেকে যায়।
স্বাস্থ্যের প্রি-ইনস্পেকশন রিপোর্ট আসে মৌসুম শেষে: কীটতত্ত্ববিদদের ওপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্ভরতা অনেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইনস্পেকশন করে এপ্রিলে আর রিপোর্ট দেয় জুলাই-আগস্টে। ফলে তাদের কার্যক্রম শুরুর আগে মশা শহর-গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় প্রি-ইনস্পেকশন করে থাকে। তারা এপ্রিল মাসে ইনস্পেকশন করে তার রিপোর্ট সিটি করপোরেশন পাঠায় জুলাই-আগস্টে। ফলে অভিযান দেরিতে শুরু হয়। ইতোমধ্যে মশা বংশবিস্তার করে ফেলে। রিপোর্ট যথা সময়ে পেলে দ্রুত অভিযান চালিয়ে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা যায়।’
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ