ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পেঁয়াজের ‘প্যাঁচে’ ক্রেতা

প্রকাশনার সময়: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:২১

ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের খবরে আবারও অস্থিরতা পেঁয়াজের বাজারে। দেশের বাজারে হু হু করে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। এ কৃষিপণ্যটির ঊর্ধ্বমুখী মূল্যপ্যাঁচে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন ক্রেতা। গত শুক্রবার থেকে দফায় দফায় বেড়েই চলছে পেঁয়াজের দাম। রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার একদিনের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১২০ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে এখন এ পেঁয়াজের কেজি ২৪০ টাকা। আর কেজিতে ৯০ টাকা বেড়ে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। কেউ কেউ ২২০ টাকাও দাম হাঁকছেন। এ অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় ১৩৩ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। রাজধানীর কারওয়ানবাজার, রামপুরা কাঁচাবাজার, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, গোদারাঘাট, উলন বাজারসহ কয়েকটি বাজার গতকাল শনিবার ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এ বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে অধিকাংশই ভারতীয় পেঁয়াজ। দেশি পেঁয়াজ যেন উধাও হয়ে গেছে। এ ছাড়া দাম বাড়তির দিকে রয়েছে রসুনেরও। একদিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০ টাকা। একই সঙ্গে সবধরনের ডালের দাম কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা এবং চিনির দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৫০ টাকা। গত বৃহস্পতিবার রসুনের দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। গতকাল শনিবার সেটি ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বৃহস্পতিবার চিনি বিক্রি হয়েছিল মণপ্রতি ৪ হাজার ৯৮০ টাকা এবং শনিবার বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৪০ টাকা করে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন— ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেও বর্তমানে দেশের বাজারে অস্বাভাবিক হারে দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। কারণ দেশে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ও আমদানি পর্যাপ্ত পরিমাণে হয়েছে। পাশাপাশি নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করেছে। রপ্তানি বন্ধের অজুহাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। তাই জোরালোভাবেই বাজার তদারকির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

পেঁয়াজ আমদানিকারক ও রাজধানীর শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘একদিকে দেশের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে, অন্যদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাড়বে, তখন এমনিতেই পেঁয়াজের দাম কমে আসবে।’ রাতারাতি এমন আকাশচুম্বী দাম বৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ ক্রেতারা। বাজারে এসে অনেকেই পেঁয়াজ না কিনে ফিরে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন বেশি দামে কিনতে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিকাল নাগাদ দাম আরও বাড়বে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। এজন্য পাইকাররা দেশি পেঁয়াজ ছাড়ছেই না। কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজারেও ভোরে যে দাম ছিল, সকাল ৯টায় তা মণপ্রতি ৮০০-১০০০ টাকা বেড়ে গেছে। বিকেল নাগাদ বাজারে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়তে পারে।

মধ্যবাড্ডা বাজারের ব্যবসায়ী সিরাজ উদ্দিন বলেন, ভোরে শ্যামবাজার থেকে বহু কষ্টে এলসির (ভারতীয়) দুই মণ পেঁয়াজ এনেছি। আমি পাইকারিতে কিনেছি ৭ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে। আনতে খরচ পড়ছে ৪০০-৪৫০ টাকা। এখন ২০০ টাকা কেজি না বেচলে তো লস। সংবাদকর্মী পরিচয়ে পেঁয়াজের বাজার দর জানতে চাইলে রামপুরা কাঁচাবাজারের খুচরা বিক্রেতা রোকন আলী বলেন, ‘ভাই, খবর লিখা লাভ নাই। পারলে দুই কেজি পেঁয়াজ লইয়া যান। দুপুর গড়ালেই কিন্তু দাম আরও ৫০ টাকা বাইড়া যাইব।’ তিনি জানান, সকালে কারওয়ান বাজারের পাইকার সুবাসের আড়ত থেকে তিন মণ পেঁয়াজ এনে খুচরা বিক্রি করছেন। কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজের মণ এখন ৮ হাজার ৮০০ টাকা। আর ভারতীয় পেঁয়াজের মণ ৭ হাজার ৬০০ টাকা। আড়তদাররা দেশি পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। সবাই ভারতীয় পেঁয়াজ এনে বিক্রি করছেন।

রাতারাতি পেঁয়াজের এমন দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। বাজারে এসে অনেকে পেঁয়াজ না কিনে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে গলাকাটা দামে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এক রাতেই পেঁয়াজের দাম এত বেড়ে যাওয়া ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। রাজধানীর মুগদা ঝিলপাড় এলাকায় পেঁয়াজ কিনতে আসা এক ক্রেতা মাইনুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজের বাজারে ঠাডা পড়ছে। না হলে এক রাইতে ১২০ টাকার পেঁয়াজ ২০০ টাকার বেশি হয় ক্যামনে। দোকানে এখনো যে পেঁয়াজ আছে এগুলা তো আগের কেনা। উলনবাজারে কথা হয় ক্রেতা সাইদুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুদিন আগেও দেশি পেঁয়াজ কিনলাম ১২০ টাকা করে। আজকে এসে দেখি সেটা ডাবল হয়ে গেছে। শুক্রবারও না কি ১৪০ টাকা কেজি ছিল। রাতের মধ্যেই বেড়ে গেল ১২০ টাকা। এটা কেমন কথা? দেশে কী কোনো সরকার নেই?

ক্রেতা সাইদুলের বক্তব্য অনুযায়ী, তার কাছে দেশি পেঁয়াজের কেজি ২৬০ টাকা চাওয়া হয়েছে। বাজারে যেসব ব্যবসায়ী দাম একটু কম রাখছেন, তাদের কাছে আগের কেনা পেঁয়াজ ছিল। নতুন যেসব পেঁয়াজ বাজারে আসছে, সেসব পেঁয়াজের দাম বেশি রাখা হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা অভিযোগ করছেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা রাতারাতি একযোগে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

পাইকারি দোকান থেকে পাওয়া একাধিক খুচরা বিক্রেতার রসিদ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে শ্যামবাজার থেকে আজ সকালে কেনা দেশি পেঁয়াজের দাম ধরা হয়েছে কেজিপ্রতি ১৭৫-১৯৫ টাকা পর্যন্ত আর আমদানি করা পেঁয়াজ পাইকারিতে কিনতে হয়েছে ১৫৫-১৮০ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো খুচরা বিক্রেতা এটাও জানিয়েছেন, পাইকারি বাজারের যেসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তারা পণ্য কেনেন, তারা অনেক সময় মাল দেয়ার জন্য ফোন দিতেন। আজ সকালে থেকে এসব পাইকারি ব্যবসায়ীর ফোন বন্ধ পাচ্ছেন। তাতে অনেক খুচরা দোকানে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। রামপুরা বাজারের তামিম এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা মাহমুদ হাসান বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন সকালে শ্যামবাজার থেকে পাইকারিতে মালামাল নিয়ে আসি। এরপর কেজিতে দুই থেকে পাঁচ টাকা লাভ রেখে বিক্রি করি। আজকে (গতকাল) সকালে পেঁয়াজ আনতে গিয়ে নিজেও রীতিমতো অবাক হয়েছি। দাম এতটা বাড়বে, তা আমার নিজেরও ধারণার বাইরে ছিল। মূলত ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধের এ খবরেই দাম বেড়েছে।’

রাজধানীর শ্যামবাজারভিত্তিক একাধিক আমদানিকারক ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বাজারে যে পেঁয়াজ রয়েছে সেগুলো আগের দামে কেনা। অথচ ভারত ঘোষণা দিল আর এই অজুহাতে একটি পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল! আমরা জানি ব্যবসায়ীরা তার খরচের সঙ্গে মিলিয়ে লাভ করে দাম নির্ধারণ করে থাকেন। কিন্তু এখন তারা যা করছেন, সেটি ডাকাতি বলা যাবে কি-না আমি শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আবার বাজারে সরকারের কোনো তদারকি নেই। ব্যবসায়ীরা যে যার যার খুশিমতো দাম বাড়াচ্ছেন। এতে করে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। অথচ চাইলে সরকার একদিকে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এবং একই সঙ্গে পেঁয়াজ আমদানির জন্য দ্রুত বিকল্প দেশ খুঁজে বের করতে পারত। এতে করে এ রকম সংকট আর তৈরি হতো না।

এদিকে, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা রোধে অভিযান পরিচালনায় মাঠে নেমেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের একটি টিম কারওয়ানবাজারের বিক্রেতাদের কাছে রশিদ দেখতে চাইলে তারা দেখান প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেনা আছে ১১০ টাকা। তারা বলছেন, ওই দরে কেনা পেঁয়াজ শেষ হয়ে গেছে। রাজধানীর অন্যান্য বাজারগুলোতেও একই অবস্থা দেখা গেছে। মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে আরও ১০-২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভোক্তা-অধিকার জানিয়েছে, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ঢাকাসহ সারাদেশে অভিযান চালানো হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকায় অধিদপ্তরের চারজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে চারটি পৃথক টিম বাজার অভিযান পরিচালনা করবে। এছাড়া দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয় সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করবে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত। যা গত শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়। ভারত সরকারের এ ঘোষণার পর বাংলাদেশের বাজারে রাতারাতি পেঁয়াজের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে শুরু করে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে আমদানি করা পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। ফলে ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় তেমন প্রভাব পড়বে না।

গত শুক্রবার এক আদেশে, ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারত। মূলত দেশের বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ভারত সরকার আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি নিষিদ্ধ করার এ পদক্ষেপ নেয়।

ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) জানায়, পেঁয়াজের রফতানি নীতি ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৮ ডিসেম্বর এ আদেশ জারি করে দেশটির সরকার। পেঁয়াজ রফতানির অনুমতি দেওয়া হবে, তবে তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অনুরোধের পর কেন্দ্রীয় সরকার থেকে দেওয়া প্রদত্ত অনুমতির ভিত্তিতে। ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ অক্টোবর টনপ্রতি পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ দেয়া হলেও সময়সীমার শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহ আগেই নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।

প্রসঙ্গত: চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো তিন কৃষিপণ্য আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে দেশি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সরকার নির্ধারিত এ দাম কার্যকর না হলেও সেই সময় ভোক্তা অধিকারের অভিযান ও আমাদানির ফলে ৭০-৮০ টাকায় নেমে আসে পেঁয়াজ। আবারও সেই পেঁয়াজের বাজারে শুরু হয়েছে অস্থিরতা।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ