দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পোশাক খাতে। চলমান আন্দোলনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ যানবাহনের ভাড়া এখন দ্বিগুণ। যা দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ১৫ হাজার টাকার ভাড়া এখন ৩০ হাজার টাকার বেশি। একই সঙ্গে শ্রমিক পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত বাস না পাওয়ায় কারখানায় উৎপাদনও অর্ধেকে নেমে এসেছে। সময়মতো পোশাক ডেলিভারি দিতে না পারলে কমে যেতে পারে ক্রয়োদেশ। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রপ্তানি আয়ে। আর এতে বিপাকে পড়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা।
বিশ্লেষকদের দাবি, প্রায় চার বছর পর সারা দেশে হরতাল-অবরোধ চলছে। দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জিং সময়ে ঘোষিত হরতালের কারণে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
গত এক মাস ধরেই প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে পণ্যবাহী ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানে আগুন দিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২৯ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে অবরোধকারীরা ২৭৫টি গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি আরও ২৯০টি গাড়িতে আগুন দিয়েছে। এদিকে ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, এ সময়ের মধ্যে সংস্থাটি ১৮৫টি গাড়ির আগুন নিভিয়েছে।
এ আগুনের ঘটনার কারণে পণ্য পরিবহনে গাড়ি ভাড়া দিতে পরিবহন মালিকরা শঙ্কিত। এ অবস্থায় হাতেগোনা কিছু গাড়ি পাওয়া গেলেও তার ভাড়া অনেক বেশি। আবার আগুন সন্ত্রাস থেকে রপ্তানি পণ্য বাঁচাতে কৌশল হিসেবে একটির পরিবর্তে তিনটি করে গাড়ি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, আমাদের ছোট ছোট গাড়িতে পণ্য পরিবহনে বাধ্য হতে হচ্ছে। পুরো পণ্যের ক্ষতি এড়াতে আমরা একটি গাড়িতে পুরো পণ্য দিচ্ছি না। এখন আমাদের মতো রপ্তানিকারকদের যে যার মতো কৌশল বের বরে পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে। যার কারণে আমাদের একটি বিশাল অঙ্কের ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে।
গত অক্টোবর মাসেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি করা কাঁচামাল ঢাকায় পাঠানো কিংবা সেখানকার কারখানায় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে আনার কাজে প্রতিটি কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া ছিল ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা। সেই ভাড়া এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে ৭ হাজার টাকার ভাড়া বেড়ে ঠেকেছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায়।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, গাড়ির মালিকরা তাদের গাড়ি ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না। কারণ যদি তাদের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়, তারা সেই আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। অভাবের কারণে যেমন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, আমরা পণ্য পরিবহনের সে রকম অবস্থাতেই পড়েছি। এতে আমাদের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে।
গত অর্থবছরে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের গার্মেন্টস পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু চলমান আন্দোলনে শ্রমিক পরিবহনকারী গাড়ি পোড়ানোতে বাড়তি টাকা দিয়েও বাস পাচ্ছেন না গার্মেন্টস মালিকরা। ফলে কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমছে।
রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি হলো গার্মেন্টসশিল্প। কিন্তু হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে এ শিল্প এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কারখানায় আমদানি করা কাঁচামাল পৌঁছানোর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের জন্য প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক ১২ থেকে ১৩ হাজার ট্রাক এবং কাভার্ডভ্যানের চাহিদা রয়েছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা সাধারণত জাহাজেই বায়ারদের কাছে পণ্য পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান সংকটের কারণে যেমন শিপমেন্ট বাতিল করতে হচ্ছে, তেমনি বাড়তি খরচে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে বিমানে।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান এসএম আবু তৈয়ব বলেন, সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলার পথে যদি এ ধরনের ব্যাঘাতগুলো আসে। পরিবহন খাতে যদি আমাদের এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। আমাদের পণ্য পরিবহনে দেরি হয়ে যায়। এতে তো আমাদের শিপমেন্ট মিস হয়। যা আমাদের জন্য একটি বড় ধরনের সমস্যা।
এদিকে হরতালে অর্থনৈতিক ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবীর বলেন, বিগত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিসংখ্যান এবং বর্তমান অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিএনপির ঘোষিত একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতিতে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, সে সময়ে একদিনের হরতালে পোশাক খাত, পরিবহন খাত, পাইকারি-খুচরা ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানি ও রাজস্ব আয় মিলিয়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বা ২০ কোটি মার্কিন ডলার (তৎকালীন ডলারের হিসাব অনুযায়ী) ক্ষতি হতো।
এ জরিপের প্রসঙ্গ টেনে মাহফুজ কবির বলেন, ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ১১ লাখ কোটি টাকা। যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ কোটি টাকা। অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরতালে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে একদিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।
বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈশ্বিক অস্থিরতার যে প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে সেখান থেকে এখনো বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে পারেনি। অন্যদিকে বাজারে মূল্যস্ফীতিও রয়েছে উচ্চমাত্রায়। এ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে হরতাল দিলে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ হবে বিপুল।
হরতালে কোন কোন খাত বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়— এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ কবীর বলেন, একদিনের হরতালে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে দেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা। এছাড়া রপ্তানি খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় পোশাক খাত।
হরতালের কারণে দেশের মোট অর্থনীতির ২০ শতাংশ ক্ষতির মুখে পড়ে। এছাড়া আমদানি-রপ্তানিতে এ ক্ষতির পরিমাণ ১০ শতাংশ এবং শুধু একদিনের হরতালের কারণে দেশে পণ্যমূল্যের দাম বাড়ে ১০ শতাংশ।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ