ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি যুক্তি ছিল যে, তুলনামূলক কম দামে বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে জ্বালানি খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে কি না সে সংশয়ও তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে এখন যা আমদানি করা হচ্ছে এবং ডিসেম্বর নাগাদ ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে যে বিদ্যুৎ পাবে সেটি যৌক্তিক দামেই থাকবে। তবে এরপর আর আমদানি করা হবে কি না সেটি সম্পর্কে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, আমদানি করা এই বিদ্যুৎ যেন গলার কাঁটা না হয়। দেশে ব্যয়বহুল কিংবা অযৌক্তিক বেশি ব্যয় হয় এমন কেন্দ্র ছাড়াও কুইক রেন্টাল কিংবা পুরোনো হয়ে পড়া কেন্দ্রগুলো বন্ধ না করলে আমদানি করা বিদ্যুতের ভারসাম্যপূর্ণ যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। ফলে একপর্যায়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বোঝা হয়ে ওঠারও আশঙ্কা আছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ভারত থেকে বাংলাদেশ ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। আগামী ডিসেম্বরে ভারতের আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের দাম এবং ভারতে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে বলেও মনে করেন অনেকে।
কর্তৃপক্ষের হিসেবে এখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। যদিও সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও সে অনুযায়ী তেল, ডিজেল ও এলএনজি আনার মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা না থাকার কারণে অনেক কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সরকারকে। যার ফলে লোডশেডিং করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সরকারের বিদ্যুৎ নিয়ে মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সাল নাগাদ আমদানি ও নবায়নযোগ্য খাত থেকে আসবে মোট বিদ্যুতের ১৫ শতাংশ। সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা পাওয়ার সেল মনে করছে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের যে দাম দাঁড়াচ্ছে সেটি যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত। সংস্থাটির মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বলেছেন যে, যখন আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন বাংলাদেশে উৎপাদন কম ছিল ও যে কোনো ভাবেই বিদ্যুতের প্রয়োজন ছিল।
মোহম্মদ হোসাইন বলেন, এটি আমরা সস্তাতেই পেয়েছিলাম। বিশেষ করে জিটুজি চুক্তির আওতায় প্রথম যে ২৫০ মেগাওয়াট এসেছিল সেটা খুব কম দামে ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন জ্বালানির দাম বেড়েছে। কখন কত দাম সেটা হিসেব রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে। ফুয়েলের দাম এডজাস্ট করতে হয়। তারপরেও এখনো যা আমদানি করছি ও আদানি গ্রুপ থেকে যা পাব সেটা যৌক্তিক। তিনি অবশ্য বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আমদানির আর প্রয়োজন হবে কিনা সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে ভবিষ্যতে।
হোসাইন আরও বলেন, আদানির পর আর আমদানি করা হবে কি না সেটি হয়তো পরে চিন্তা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। যদিও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সংকটের জন্য নেয়া হয়নি। বরং সেটি হয়েছিল ক্রসবর্ডার বাণিজ্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এটি পরিকল্পনাতেই ছিল যে বাণিজ্যের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ নেয়া হবে। আদানি যেটি করছে সেটি বাংলাদেশেরই বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশে কয়লার জন্য বন্দরসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা নেই সে কারণে আদানি নিজস্ব বিনিয়োগে সেটি ভারতে করছে।
কিন্তু সমস্যা হলো সে কেন্দ্রের লাভ বা আয় থেকে বাংলাদেশ কিছু পাবে না। তিনি বলেন, এ বিষয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- কয়লার দাম বেশি হলে সেটি দেশে হলে হয়তো কেন্দ্রটি বসিয়ে রাখা যেত কিন্তু ভারতে থাকায় কেন্দ্রের ক্ষেত্রে দাম যতই হোক বাংলাদেশকে তা নিতেই হবে, না হলে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি অতখানি অস্থিতিশীল হবে বলে মনে হয় না। আমদানি করলেই ব্যয়বহুল হবে তা নয়। বরং ব্যয়বহুল হলে দেশেও যা, ভারতের ক্ষেত্রেও তাই।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে নয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের। তুলনামূলকভাবে দেশীয় ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস বা ডিজেল চালিত বিদ্যুতের তুলনায় আমদানি করা বিদ্যুতে ইউনিট প্রতি খরচ কম পড়ে বাংলাদেশের। প্রসঙ্গত, শুধুমাত্র বাংলাদেশকে দেয়ার উদ্দেশ্যে ভারতের ঝাড়খণ্ডে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেছে আদানি গ্রুপ। তবে অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চেয়ে এখানে বেশি দাম ধরা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারের হাতে এলএনজি ও ডিজেল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। এ প্রেক্ষাপটে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ দিয়ে ঘাটতি মেটাতে পারলে সেটা মন্দের ভালো হবে। তবে এটি হতে পারে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে। মোটা দাগে দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখলে ক্যাপাসিটি পেমেন্টে দিতে হবে বিপুল পরিমাণ। সে কারণে আমদানির যে চ্যালেঞ্জ তাকে যৌক্তিক পর্যায়ে যেতে হলে দেশে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল কেন্দ্রগুলো কিংবা কুইক রেন্টালের অবসান ঘটাতে হবে। তাহলেই আমদানি করা বিদ্যুতের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং এটিকে বোঝা মনে হবে না। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে না এলে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সমস্যা থেকেই যাবে বলে মনে করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
আমদানি নির্ভর বিদ্যুৎ খাত: বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতার কথা জোরেশোরে বলা হলেও এখনো দেশটির উৎপাদন ক্ষমতার বড় একটি অংশ নির্ভর করছে আমদানি করা জ্বালানির ওপরে। কারণ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা তেল, কয়লা বা গ্যাসের একটি বড় অংশ আমদানি করতে হয়।
সরকারের সর্বশেষ মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, তাতে গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, কয়লায় ৩৫ শতাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বাকি ৩০ শতাংশ তেল, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে। কিন্তু এর কোনটার জ্বালানি পুরোপুরি দেশীয় উৎস থেকে জোগান দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, তেল বা কয়লার দাম বাড়া বা কমার প্রভাব পড়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে।
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ