ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কী হচ্ছে পর্দার আড়ালে?

প্রকাশনার সময়: ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:২১

চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে নানা গুঞ্জন ভাসছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বাতাসে চাউর আছে কখনো লন্ডন কখনো কারাগারে চলছে সমঝোতার চেষ্টা। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। তারপরও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে। এছাড়া সমপ্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দৌড়ঝাঁপও পর্দার আড়ালে সমঝোতার ইঙ্গিত বহন করে। এখন কোন দিকে যাচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি সেটাই দেখার বিষয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের দিক চিন্তা করে দুই দলকেই আলোচনার টেবিলে বসা উচিত। যদি সমঝোতা না হয় এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তা হলে আগামীতে কঠিন সংকটে পড়তে পারে দেশ। যার খেসারত দিতে হবে সাধারণ জনগণকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। যাতে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়-এ কাজটি এখন নির্বাচন কমিশনকেই করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ম্যান্ডেট শুধু নির্বাচন করা নয়, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন হলে এটা কোনো নির্বাচনই না। সমঝোতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের এগিয়ে আসা ছাড়া এ সমঝোতা সম্ভব নয়। কারণ সরকারের হাতেই সব ক্ষমতা, বল সরকারের কোর্টে। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে।

সূত্রমতে, গুঞ্জন রয়েছে বিএনপি ভোটে না এলে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাপে পড়বে আওয়ামী লীগ। এমনকি বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে তার বৈধতা নিয়েও চাপ আসতে পারে। এ জন্য বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য সরকারের দিক থেকে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাতাসে চাউর আছে কখনো লন্ডন কখনো কারাগারে চলছে সমঝোতার চেষ্টা। কিন্তু এতে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পায়নি আওয়ামী লীগ। গুঞ্জন রয়েছে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা মিটিং করেছেন। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। সব প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন তারেক রহমান। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিএনপি এখন এক দফাতে রয়েছে। সেখান থেকে পেছানোর সুযোগ নেই। পেছালে রাজনৈতিক পরাজয় ঘটতে পারে। এ কারণে সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যাবেক্ষণ করা হচ্ছে। সরকারের কোনো ফাঁদে পা দেবে না বিএনপি।

এদিকে কারাগারের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গেও কয়েক দফা বৈঠকের চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথাই বলেননি মির্জা ফখরুল। তাদের ফখরুল সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আপনারা সরকারের লোক আপনাদের সঙ্গে কোনো কথা নেই। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তবেই সংলাপ সম্ভব বলে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলকে জানিয়ে দেন। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নয়া শতাব্দীকে নিশ্চিত করেছে দায়িত্বশীল একটি সূত্র।

ওদিকে দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। সেই অবস্থান থেকে নড়তে নারাজ পশ্চিমা দেশগুলো। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা প্রয়োগ করবে তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তারা। সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য এমনকি বিরোধী দলের কেউ যদি তাতে জড়িত থাকে সবার বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পশ্চিমারা।

এমন পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শর্তহীন সংলাপ চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ আহ্বান জানিয়ে দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এতে সব পক্ষকেই পূর্বশর্ত ছাড়া সংলাপে বসার অনুরোধ জানান হয়েছে। গত সোমবার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি এক বিবৃতিতে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরতে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে পিটার হাস দেশ ছাড়েন। এর আগে বুধবার বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন। সেখানে কী আলাপ হয়েছে তা জানা না গেলেও সরকারকে চাপে রাখতেই ওই বেঠক বলে একটি সূত্র দাবি করেছে।

এর আগে গত সোমবার রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের অফিসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন পিটার হাস। এরপর ওইদিন রাতেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জি এম কাদের। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কী বিষয়ে আলাপ হয়েছে তা স্পষ্ট না করলেও জি এম কাদের বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে অনেকেই স্যাংশন খেতে পারেন। এ ঘটনার পর গতকাল পর্যন্ত দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দুই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে। তবে সঠিক তথ্যের জন্য আরও দু-একদিন অপেক্ষা করার কথা বলেছেন জাপার একাধিক নেতা। এদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জাতীয় পার্টির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পিটার হাসের চিঠির বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছেন জি এম কাদের।

জাপা চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মাসরুর মওলা মাসরুর জানান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস চিঠিতে বলেন ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। যাতে জনগণের আশা পূরণ হয়।

এদিকে ওই সোমবারই ডোনাল্ড লু’র চিঠি আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত পৌঁছে দেন পিটার হাস। ওই চিঠির পর শুক্রবার দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, এখন আর সংলাপের সুযোগ নেই। তবে আওয়ামী লীগের একটি সূত্রমতে, ওই চিঠি পাওয়ার পর কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। এরপর থেকে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে সূত্র দাবি করেছে। বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপির শীর্ষনেতাদের কারাগারে রেখে কোনো ধরনের সমঝোতার কথা শুনতেও রাজি নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র পাঠানো চিঠির জবাব দিয়েছে বিএনপি। গত বুধবার রাতে এ তথ্য জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি বলেছে, হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে সংলাপের পরিবেশ নেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে থাকায় তার স্থলে দায়িত্ব পালন করা দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী চিঠিতে সই করেছেন। তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সংলাপে বিএনপির আপত্তি নেই। কিন্তু দলের মহাসচিবসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে সংলাপ করার মতো পরিবেশ আছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দলটি।

চিঠির বিষয়বস্তুর বিষয়ে রিজভী বলেন, চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে সাধুবাদ জানান হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে কার্যত সংলাপের কোনো পরিবেশ নেই। সংকট উত্তরণে এখন সরকারকেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারকে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের। জবাব পাঠানোর আগে গত মঙ্গলবার রাতে চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করেন নেতারা। এ বৈঠকে সংলাপ ইস্যুতে বিএনপিকে দেয়া ডোনাল্ড লু’র চিঠির উত্তর দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।

বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, বুধবার তফসিল ঘোষণার পর বিভিন্ন জেলার শীর্ষনেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সভা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতাদের করণীয় সম্পর্কে নানা দিকনির্দেশনা দেন। এছাড়া সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও সভা করেন দলটির হাইকমান্ড। সেখানে চলমান অবরোধ শেষে আজ রোববার থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর লাগাতার হরতাল বা অবরোধ পালনের বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।

সূত্র জানায়, ১৪ এবং ১৮ সালের মতো আওয়ামী লীগকে ছাড় দিতে নারাজ বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। এখন চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে তারা, এখান থেকে পিছনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি নিয়ে ‘ডু অর ডাই’ আন্দোলন করবে তারা। আওয়ামী লীগের ফাঁদে আর পা দেবে না তারা। বিগত নির্বাচনে সরকার বিএনপিকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। এবারও সরকার আগের মতো আরেকটি পাতানো নির্বাচন করতে চায়, তাই এবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা দিবে না তারা।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ