ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাড়ছে জীবনমানে অভিঘাত

প্রকাশনার সময়: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৪

স্বাধীনতা পরবর্তী ৫২ বছরে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সাফল্য ঈর্ষণীয়। কিন্তু এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ১৮ ভাগের বেশি মানুষ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন মাথাব্যথার কারণ। ক্রমেই বাড়ছে জীবনমানে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত। ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

মূল্যস্ফীতির কষাঘাত হয়তো আরও অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হবে। শিগগিরই এ চাপ থেকে মুক্তির তেমন কোনো আশা নেই। নেই সহজে স্বস্তি পাওয়ারও কোনো উপায়; বরং মূল্যস্ফীতিকে মেনে নিয়ে এ ভেবে সান্ত্বনা পেতে হবে যে দুনিয়াজুড়েই কম-বেশি মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশ বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি, সুদের হারসহ বিভিন্ন ধরনের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন পর্যন্ত কমছে। বিনিময় হার নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো আছে। এখন রিজার্ভ নিয়ে আমাদের একটা লাইন টানা উচিত যে এই সীমার নিচে আমরা যাব না। এরপর আইএমএফকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে সরকার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করবে, সেটাই কাম্য।’ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা বলা হচ্ছে না। শুধু পত্রিকাতেই জনগণের দুর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়েও আমরা তেমন কিছু দেখছি না। পৃথিবীর সব দেশ কী হাতিয়ার ব্যবহার করেছে, আর আমরা কী করছি? বরং গত মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হয়েছে, কিন্তু দাম কমেনি। বিশ্ববাজারে সব খাদ্যপণ্যের দামই প্রায় আগের জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। তাই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বিনিময় হার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক বছরের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী এবং ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত মে মাসে (৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ)। একই মাসে গত বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। আগস্টে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাক জাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ২০২০ সালে খাদ্য খাতে ১০০ টাকার পণ্যে ৫ টাকা ৫৬ পয়সা বৃদ্ধি হয়েছিল। একই পণ্যে ২০২৩ সালের আগস্টে বেড়েছে ১২ টাকা ৫৪ পয়সা।

সরকার ১০০টির বেশি সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু সুফল পাচ্ছে না, সুবিধাবঞ্চিত অনেক মানুষ। অর্থাৎ তিন কোটির বেশি মানুষ ন্যূনতম নাগরিক সুবিধার অনেকটাই বঞ্চিত। আর অতি দারিদ্র্যের কাতারে বসবাস করছে দেশের প্রায় ৬ শতাংশ মানুষ। করোনার অভিঘাত, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থমকে দিয়েছে অগ্রযাত্রা। যতই দিন যাচ্ছে, সমাজে ততই বৈষম্য বাড়ছে। গরিবদের তুলনায় বাড়ছে ধনীদের আয়। এর ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে অস্থিরতা। সংখ্যার হিসেবে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ায় স্বস্তিতে নেই সাধারণ মানুষ। এমন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী পালিত হলো আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস।

অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পুষ্টির সূচকে পিছিয়ে পড়ছি। ক্ষুধার সূচকেও দেখার বিষয় আছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিও জটিল। নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আরও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। টিসিবির কার্যক্রম আরও বাড়ানো যেতে পারে। সহায়তা কার্যক্রমের বিষয়গুলো আরও সম্প্রসারণের বিষয় রয়েছে। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অনেক সময় সরবরাহের ঘাটতির কারণে এ সমস্যা তৈরি হয়, খাদ্য সংকট ইত্যাদি। এখানে ক্রয়ক্ষমতা মূল সমস্যা। ক্রয় ক্ষমতার সংকটটা তৈরি হয়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে অসহায় অবস্থায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। গত ১৫ বছরে ক্ষুধা জয়ের ক্ষেত্রে অনন্য সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

মানুষের জীবনমান নিঃসন্দেহে বেড়েছে। তবে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির যে ভয়াল দৈত্য দেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছে তাতে ক্ষুধার জ্বালা না বাড়লেও জীবনমান কমছে। খাদ্যপণ্যের পেছনে অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অন্যান্য খাতের চাহিদা অপূরণ থাকছে। এমনকি চিকিৎসা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কৃচ্ছ্রসাধন চলছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে এর ধকল বেশি। গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে শহরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এটা হচ্ছে আমাদের সার্বিক মূল্যস্ফীতির চিত্র। অন্যদিকে প্রান্তিক আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবার আগে আমলে নিতে হয়।

এদিকে বড় সংখ্যক মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বেশিরভাগ মানুষ যা আয় করছে, ব্যয় হচ্ছে তারও বেশি। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে মানুষ।

এ ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দেশে যে দাম বেড়েছে, তা ব্যয়জনিত বা চাহিদাচালিত কিংবা মুদ্রা সরবরাহের কারণেও হয়নি। এটা আমদানি করা মূল্যস্ফীতি। আমদানি করা মূল্যস্ফীতির ওষুধ কিন্তু ভিন্ন। সেখানে সুদের হার বাড়িয়ে এটাকে খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণত মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ে, সে হারে কমে না। উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়লে তা ধীরে ধীরে কমে আসে। এজন্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উৎকর্ষ করতে পারলে তা কমে আসবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, গত অর্থবছরের ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারলে এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করা সম্ভব হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক চারটি কারণ দেখিয়েছে। এগুলো হলো— দেশের বাজারের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি; দুর্বল মুদ্রানীতি; টাকার অবমূল্যায়ন; সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক এ ব্যাপারে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। মানুষের ভোগ চাপের মুখে পড়েছে। মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় খাবারের দাম বেশি বেড়েছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। তাদের কেনার সামর্থ্য কমেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সুদের হারের সীমা পর্যায়ক্রমে তুলে দেয়া উচিত। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের কার্যকর তদারকির মাধ্যমে আর্থিক খাতের ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, ‘এখনো আমি বাংলাদেশের বিষয়ে আশাবাদী। কয়েক বছরজুড়ে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। বাংলাদেশ জনমিতির সুবিধা পাচ্ছে। এ ছাড়া রপ্তানি বাজারেও বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বাড়ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে নীতি সমন্বয় করতে হবে।’ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির সঙ্গে মিলিয়ে রাজস্ব নীতি পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার লড়াইটা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ