নির্বাচনের আগে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা বা চুক্তি হচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জরিপ শেষ করে সময় নিয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সম্মত হয়েছে ঢাকা ও ওয়াশিংটন। এ কাজে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বা ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এগোয় মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল। তবে সরকারের এই মেয়াদে তা শেষ পর্যন্ত হলো না। কেবল তেল-গ্যাস অনুসন্ধানই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপাতত কোনো ধরনের বিনিয়োগ চুক্তিই হচ্ছে না বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এক দশকেরও বেশি আগে দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে বাংলাদেশ। নানা চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কার্যকর সাড়া মেলেনি। সম্প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি বা পিএসসি সংশোধন করেছে সরকার। তারপর মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিলের কাছ থেকে আসে সুনির্দিষ্ট ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে দু’পক্ষের। ধারণা করা হচ্ছিল, আগস্টের মধ্যেই চূড়ান্ত সমঝোতা হবে। তবে সেই অবস্থান থেকে পিছু হটেছে উভয়পক্ষই। একই কাজে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছিল আরেক কোম্পানি শেভরনও।
এ নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, যে ড্রাফট কপি নিয়ে আমরা এগোচ্ছিলাম, সেটি নিষ্পত্তি হতে আমাদের উভয়পক্ষেরই সময় লাগবে। কোনো পক্ষেরই এ নিয়ে তাড়াহুড়া নেই। কারণ এ ধরনের চুক্তি আমরা এই প্রথম করতে যাচ্ছি। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে সার্ভে শেষ হবে। এখন তারাও সার্ভে করতে চাচ্ছে। ফলে এ নিয়ে একটু সময় লাগবে।
নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে বর্তমানে ঢাকা-ওয়াশিংটন টানাপোড়েন বেশ দৃশ্যমান। তার প্রভাবেই তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সমঝোতা হলো না কিনা, এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব মেলেনি। তবে এ আলোচনা বাস্তবায়নে ঢাকাও যে সময় নিচ্ছে, তা স্পষ্ট করেছেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, সার্ভের আগেই দুটি কোম্পানির কাছ থেকে আমরা প্রস্তাব পেলাম। আরও যদি কেউ সার্ভে করে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমরা যাব। এটা অবশ্য নির্ভর করবে, আগামী যে সরকার আসছে তার ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতারের সঙ্গে আলোচনার পর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনও স্পষ্ট করেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে ভোটের আগে নতুন কোনো চুক্তি সইয়ের সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়েছে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মোবিল। চলতি বছরই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির সম্ভাবনা ছিল। আর বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অন্তত ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মোবিল। তাদের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ ব্যাপারে আলোচনায় বসতে বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক মানের আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জ্বালানি বিভাগ-সূত্র নিশ্চিত করেছে। চলমান জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় এক্সন মোবিলের প্রস্তাবকে সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখছেন জ্বালানি-বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে নিজেদের স্বার্থেই মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সাগরে অনুসন্ধানে আগ্রহী। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা সুযোগ। এ সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। এতে গভীর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দুয়ার খুলবে। তবে চুক্তির বেলায় যেন নিজস্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের অংশে ২৬টি ব্লক রয়েছে। অগভীর সমুদ্রে ১১টি এবং গভীর সমুদ্রে ১৫টি ব্লক। আগে প্রতিষ্ঠানটি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গভীর সমুদ্রের সব ব্লক চেয়েছিল। তবে একক কোনো কোম্পানিকে সব ব্লকে কাজ না দেওয়ার বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। ওই প্রস্তাবের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনা হয়। এখন তারা বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। গত ১৬ জুলাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে চিঠি দিয়ে এক্সন মোবিল বলেছে, গভীর সমুদ্রে কী পরিমাণ জ্বালানি মজুত আছে তার মূল্যায়নের জন্য দ্বিমাত্রিক জরিপ করতে ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে তারা। এ জরিপে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে আরও নিশ্চিতির জন্য পরে ত্রিমাত্রিক জরিপ করবে। এতে ব্যয় হবে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পুরো নিশ্চিত হওয়ার পর প্রতিটি কূপের উন্নয়নে ৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি গভীর সাগরে অনুসন্ধান কাজে ১০ থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখিয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। চিঠিতে তারা বলেছে, পুরো প্রক্রিয়া সফল হলে বাংলাদেশ এখন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে যে পরিমাণ ব্যয় করছে প্রতি বছর তাতে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে। এক্সন মোবিল প্রতিষ্ঠানটি এ বছরের নভেম্বরেই দ্বিমাত্রিক জরিপ শুরু করতে আগ্রহী ছিল। এজন্য আগস্টের মাঝামাঝিতে আলোচনার জন্য প্রস্তাবও দিয়েছিল তারা। অনুসন্ধানে সাফল্য না এলেও এক্সন মোবিল বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত রয়েছে বলে ওই চিঠিতে জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানের জন্য কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানি আগ্রহী দেখিয়েও পরে চলে যায়। তবু আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে পিএসসি সংশোধন করা হচ্ছে। এতে আবার বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি সংশ্লিষ্ট আছে।’ তিনি বলেন, ‘এক্সন মোবিলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারা বাংলাদেশে আসতে পারে ওই জিওপলিটিক্যাল কারণে। কারণ তারা এক জায়গায় সব গ্যাস কূপের ওপর নির্ভরশীল হতে না চায়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এসে তারা যদি এখানে কিছু পায় তাহলে তাদের সাপ্লাই চেইনে নতুন মাত্রা যোগ হবে। আমার ধারণা তারা তাদের জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের উৎস থেকে কখনো জ্বালানি পেতে সমস্যা হলে তাদের সরবরাহে যেন সমস্যা না হয়। ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে এক্সন মোবিল বাংলাদেশে আগ্রহী হয়ে থাকতে পারে। দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে।’
সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি (মডেল পিএসসি-২০২৩) চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সূত্রমতে, এক্সন মোবিলের প্রস্তাব পর্যালোচনা করতে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন এবং পিএসসি সংশোধন চূড়ান্ত হলে তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে সরকার। এক্সন মোবিলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্লকগুলোতে টুডি সিসমিক সার্ভে বা জরিপ করতে দুই বছর এবং থ্রিডি সিসমিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য সময় লাগবে আরও তিন বছর। ভূ-তত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, ‘সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির পর প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার তাদের অংশে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করছে। বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস পাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেখানে স্থবিরতা বিরাজ করছে। গত ২০ বছরে কোনো অনুসন্ধান-পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। স্থলভাগেও অনুসন্ধান চলছে ঢিমেতালে। ফলে দেশে বড় ধরনের গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। ঘাটতি মেটাতে সরকারের আমদানি-নির্ভরতা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে এক্সন মোবিল যে আগ্রহ দেখিয়েছে তা বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক।’ তিনি বলেন, ‘এক্সন মোবিল বিশ্বের অন্যতম সেরা কোম্পানি। গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে তাদের দক্ষতা অনেক বেশি। তাদের আগ্রহের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবে। সুতরাং তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। তবে বাংলাদেশের স্বার্থ যাতে অটুট থাকে সে খেয়ালও রাখতে হবে।’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ মাহফুজ কবীর বলেন, ‘এক্সন মোবিল বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান। ৫০-৬০ বছর আগেও তারা এ এলাকায় ছিল। তাদের আবার আসতে চাওয়া আমাদের জন্য ইতিবাচক। তারা কাজ করলে সাগরে কী পরিমাণ জ্বালানি মজুত আছে তা জানতে পারব আমরা। পাশাপাশি আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে। তবে সম্ভাব্য সম্পাদ্য চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাপেক্সের কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে যাতে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা বাড়ে।’
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ