ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রিজার্ভে চাপ বড় হচ্ছে

প্রকাশনার সময়: ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৪২

দর ঠিক রাখতে নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ প্রতিনিয়ত কমছে। প্রবাসী আয় কিছুটা বাড়লেও রপ্তানি আয় কমা ছিল অস্বাভাবিক। এছাড়া গত দুই মাসের আকুর বিল পরিশোধ করার কথা আজ। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপ আরও বড় হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রতি দুই মাস পর পর আকুর আওতাধীন দেশগুলো দায় পরিশোধ করে। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর দুই মাসের দেনা ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আজ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। এই দায় পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত সেপ্টেম্বরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ তিন দশমিক ১৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৪৩ কোটি ডলার। গত আগস্টে তা ছিল ১২ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার।

স্বল্পমেয়াদি ঋণ তিন থেকে নয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় এবং তা বিদেশ থেকে নেয়া বেসরকারি খাতের মোট ঋণের ৬৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ। কিন্তু ডলারের কম মজুদ, টাকার অবমূল্যায়ন ও বৈশ্বিক সুদের উচ্চহারের কারণে উদ্যোক্তারা এ ধরনের ঋণ এড়িয়ে চলছেন।

গত জানুয়ারির শুরুতে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। এরপর তা কমে হয়েছে ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত নয় মাসে উদ্যোক্তারা ১৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছেন এবং মূল অর্থ ও সুদ বাবদ ২৩ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার শোধ করেছেন। নতুন ঋণের তুলনায় ঋণ পরিশোধের উচ্চহার জানুয়ারি থেকে চলমান আছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়নের কারণে বেসরকারি খাত ডলারে ঋণ নিতে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর আগে বিদেশি ঋণের সুদের হার ছিল দুই শতাংশ। এখন উদ্যোক্তারা ১০ শতাংশ দিতে রাজি হলেও ডলারে ঋণ পাচ্ছেন না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিদেশি ঋণের ওপর ২০ শতাংশ কর আরোপ করেছে। বিদেশি ঋণ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো—ভুল সময়ে এই নীতি আরোপ করা হয়েছে। পাঁচ বছর আগে যদি এটা আরোপ করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভালো হতো।

২০২১ সালে বেসরকারি খাত বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদে ৩৩ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে। গত বছর ৩৭ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার নতুন ঋণের বিপরীতে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ঋণের তুলনায় বেশি পরিমাণে ঋণ পরিশোধ দেশের রিজার্ভ কমিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১ নভেম্বর দেশের মোট রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। গত ২৫ অক্টোবর তা ছিল ২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার।

আইএমএফের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪০ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ও ২০২১-২২ সালের শেষে তা ছিল ৩৩ দশমিক চার বিলিয়ন ডলার।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, চলতি হিসাব উদ্বৃত্তের কারণে নয় বরং, আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্তের কারণে রিজার্ভ বেড়েছিল। অর্থাৎ, ঋণের ওপর ভর করে রিজার্ভ জমেছিল। এখন সেই ঋণ শোধ করা হচ্ছে। ফলে আর্থিক হিসাব নেতিবাচক হয়ে পড়েছে এবং রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত জুনে শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ছিল তিন দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে, আগের বছরের একই সময়ে এটি ৮৩৯ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আমদানি সীমিত করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের পর চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের আমদানি কমেছে ২২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। আগের বছরের একই সময়ে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সূত্রমতে, ধারাবাহিকভাবে বাজারে ডলার বিক্রি করার কারণে রিজার্ভের ক্ষয় হচ্ছে। এখনই ডলার সংকট কাটাতে না পারলে রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায় ওঠে। ওই বছরের আগস্ট মাসে রিজার্ভ উঠেছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রির কারণে তা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আজ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করার কথা। এতে করে রিজার্ভ আরও কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাবে।

জানা যায়, রিজার্ভ বাড়াতে ও আর্থিক হিসেবের ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণের খোঁজে নামছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ নিতে ভারত ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। সমপ্রতি ১৫ জন বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে আলোচনার সময় এ অবস্থান তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

ডলার সংকট ও বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে আমদানি অনেক কমেছে। এতে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। তবে বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ কমে যাওয়া রেকর্ড আর্থিক ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি কমেছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে ১৮২ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৭৫৮ কোটি ডলার। এদিকে বিদেশি ঋণ কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক সংকট নিরসনে ডলারের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা খুবই জরুরি। কিন্তু এবিবি ও বাফেদা দাম বেঁধে দেয়ার কারণে দামে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তাই ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা না গেলেও ধাপে ধাপে সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সংকট আরও গভীর হবে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ