ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘হট স্পট’ সদরঘাট

প্রকাশনার সময়: ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৩০ | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ১০:০১

রাজধানীর সঙ্গে দেশের-দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। নৌপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কোনো চেকিং না থাকায় সহজে পাচার হচ্ছে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক।

ডিএনসি সংশ্লিষ্টরা বলছে, আগে নিয়মিত বিমান ও স্থলপথে ইয়াবা আসলেও মাদক কারবারিরা তাদের রুট পরিবর্তন করে এখন নৌপথকে বেশি ব্যবহার করছেন। এজন্য প্রথমে ঢাকার আশপাশের জেলায় মাদকের চালান মজুত করা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে নৌপথে সেসব চালান পাঠানো হয় রাজধানীতে। এর মধ্যে বিভিন্ন বাহিনীর সম্মিলিত অভিযানে দু-একটি চালান ধরা পড়লেও অধিকাংশ মাদকের চালান নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রমতে, গত ১৯ অক্টোবর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর উত্তরের একটি টিম সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ফাতেমা (৩৫) ও মোছা. মমিনা বেগম (২০) নামের দুই নারীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে ১২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার দুই নারীর বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অতিরিক্ত পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান মো. মজিবুর রহমান পাটওয়ারী জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা টেকনাফ থেকে প্রথমে ইয়াবার চালান নিয়ে চাঁদপুরে আসেন। পরে লঞ্চে করে ইয়াবার চালান ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে থাকা লাগেজের বিশেষ চেম্বারে ইয়াবাগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা একই পদ্ধতি অবলম্বন করে একাধিক ইয়াবার চালান ঢাকায় নিয়ে এসেছেন।

ডিএনসির এ কর্মকর্তা জানান, ঢাকার প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ডিএনসির নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় মাদক কারবারিদের আরেকটি চক্র ইয়াবা নিয়ে টেকনাফ থেকে প্রথমে চাঁদপুর যায়। পরে নৌপথে আসে ঢাকায়। এর আগে গত ১৭ অক্টোবর ডিএনসির চাঁদপুর স্টেশনের সদস্যরা চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে ঢাকাগামী এমভি মিতালী লঞ্চে অভিযান চালিয়ে ৫৬ কেজি গাঁজাসহ মাদক বিক্রেতা মো. জানু মিয়াকে আটক করে।

জানু জিজ্ঞাবাসাদে জানায়, জব্দ গাঁজা কুমিল্লা হতে বিক্রির উদ্দেশে চাঁদপুর হয়ে লঞ্চযোগে ঢাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে তিনি নেপৈথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকায় আসে। এ পদ্ধতিতে তিনি একাধিক গাঁজার চালান ঢাকায় এনেছেন।

গত ১৩ আগস্ট চাঁদপুর হরিণা ফেরিঘাট এলাকা থেকে ২১ কেজি গাঁজা ও ১৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ মো. বাবুল মিয়া ও রজমান আলী নামে দুই মাদক বিক্রেতাকে আটক করে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রেইডিং টিম। এর একদিন আগে ১২ আগস্ট কোস্টগার্ড চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে ঢাকাগামী এমভি রফরফ-৭ লঞ্চে অভিযান চালিয়ে নরসিংদী জেলার মাদক বিক্রেতা আমির হোসেনকে ৪২ কেজি ২০০ গ্রাম গাঁজাসহ আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমির হোসেন জানান, মাদকগুলো কুমিল্লা হতে বিক্রির উদ্দেশে চাঁদপুর হয়ে লঞ্চযোগে ঢাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সীমান্তসংলগ্ন জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন নৌপথে ফেনসিডিল ও গাঁজা রাজধানীতে ঢুকছে। আর রাজধানী থেকে ইয়াবা, হেরোইন ও অন্যান্য মাদক নিরাপদে পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত জেলাগুলোতে। গত তিন মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের সদস্যরা কয়েকটি মাদকের চালান আটক করতে সক্ষম হলেও অধিকাংশ চালান ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পাচারকারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে মাদক পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে নৌপথকে বেছে নেয়ায় প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চল থেকে সাগরপথে রাজধানীতে আসছে মাদকের চালান। গভীর রাতে এসব চালান লঞ্চ থেকে নির্বিঘ্নে খালাস হয়ে ঢুকে পড়ছে রাজধানীতে।

জানা গেছে, সদরঘাটের ঢাকা নদীবন্দর দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার ৪২টি নৌরুটে প্রতিদিন শতাধিক যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করছে। এসব লঞ্চে মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে দীর্ঘদিন ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। অভিযোগ রয়েছে, মাদক কারবারিদের সঙ্গে লঞ্চের কতিপয় মাস্টার, ড্রাইভার, খালাসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের সহায়তায় রাজধানীতে ঢুকে পড়ছে এসব মাদকের চালান। আবার কখনো রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে এসব মাদক।

সদরঘাটের একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও লঞ্চের স্টাফ বলেন, সদরঘাট টার্মিনাল দিয়ে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাদক ঢুকে পড়ছে। লঞ্চপথে কোনো ধরনের তল্লাশি না থাকায় পাচারকারীরা দীর্ঘদিন ধরে এ পথ দিয়ে মাদক আনা-নেয়া করছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একাধিক অভিযানে ঢাকা-বরগুনা ও ঢাকা-আমতলী রুটে চলা লঞ্চ থেকে ঢাকা ও চাঁদপুর থেকে আসা যাত্রীবেশী কারবারিদের কাছ থেকে একাধিকবার গাঁজার চালান উদ্ধার করা হয়েছে। একইভাবে দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে আসা সদরঘাট পৌঁছানো লঞ্চে অভিযান চালিয়ে ঢাকাগামী যাত্রীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে।

সূত্রমতে, গাঁজা ও ইয়াবা এ দুধরনের মাদক কারবারি আলাদা। যারা গাঁজার কারবার করেন তাদের অনেকেই ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত নয়। আবার ইয়াবা ব্যবসায়ীরাও গাঁজা ব্যবসায় কম জড়িত। এসব কারবারি টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও বান্দবান এলাকা থেকে গাঁজার চালান নিয়ে বিভিন্ন রুটে ঢাকা ও চাঁদপুরে হয়ে লঞ্চযোগে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে গাঁজার চালান নিয়ে আসে। ব্যবসার সুবিধার্থে এরা চট্টগ্রাম কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় মাদক কারবারিদের আত্মীয়স্বজন বিয়েও করেছেন অনেকে। সেখানে থেকে মাদকের চালান নিয়ে নারীদের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এলাকায় নিয়ে আসেন। লঞ্চে তল্লাশি কম হওয়ায় মাদক কারবারিরা লঞ্চকেই মাদক চালানের জন্য নিরাপদ মনে করেন। এ ছাড়াও নারীদের সন্দেহ ও তল্লাশি কম হওয়ায় ক্যরিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা করে মাদক কারবারিরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইয়াবা মায়ানমারে তৈরি। এগুলো কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে সমুদ্রপথে মৎস্য ট্রলারে করে মাদকের বড় বড় চালান আসে। চারদিকে নদী থাকায় যে কোনো পয়েন্টে ট্রলার থামিয়ে চোরাকারবারিরা মাদকের চালান খালাস করে। এর মধ্যে স্থানীয় বেশ কিছু ইয়াবাকারবারি জড়িত। যারা মূলত ইয়াবার চালান গ্রহণ করে ক্যারিয়ারের হাতে পৌঁছে দিতে কাজ করেন। এরপর ইয়াবার এসব চালান লঞ্চযোগে নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

জানতে চাইলে ডিএমপির কোতোয়ালি থানার ওসি শাহীনুর রহমান বলেন, গত তিন মাসে আমরা কয়েকটি মাদকের চালান আটক করেছি। গত শনিবার সদরঘাট থেকে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ এক মাদক পাচারকারীকে আটক করা হয়। তার কাছ থেকে পাচারকারী চক্র সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই সূত্র ধরে পাচারকারী চক্রের আরও সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী। এজন্য ঘাট এলাকায় পুলিশি তৎপরতা আরও জোরদার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, নৌপথে কম নজরদারি থাকায় সুযোগ নিচ্ছে মাদক কারবারিরা। আসলে লঞ্চে গণতল্লাশির সুযোগ কম। তবে আমরা নৌপথের গণপরিবহনে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও মাঝে মাঝে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এছাড়া সদরঘাট নদী বন্দরে সীমানা জটিলতা অনেক বেশি। আমাদের সীমানা হল পুরোনো টার্মিনাল থেকে পশ্চিম দিকে। পার্কিং ইয়ার্ড থেকে লালকুঠি ঘাট এলাকা সূত্রাপুর থানায় পড়েছে। নদীতে নৌপুলিশ এবং ওই পাড়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকা পড়েছে। তার পরও আমরা মাদক চোরা কারবারিদের ধরতে তৎপর রয়েছি।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ