ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভয়ঙ্কর রাতের পার্ক

প্রকাশনার সময়: ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:২৬

রাজধানী ঢাকায় শিশু অথবা প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদন ও শরীরচর্চায় পর্যাপ্ত পার্কের অভাব রয়েছে। পরিবেশসম্মত স্থানের অভাবে রাজধানীবাসী বিনোদনের খোরাক মেটাতে পারছে না। তাই সন্ধ্যা নামলেই অলিগলিতে চায়ের দোকানে চলছে মানুষের আড্ডা। কারণ ঢাকায় যে কয়টি উদ্যান আছে সেগুলোও অপরাধীদের দখলে।

সম্প্রতি সরেজমিন রাজধানীর রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পান্থকুঞ্জে গিয়ে দেখা গেছে, দিনের বেলায় ভালো পরিবেশ থাকলেও রাতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে পার্কগুলো। অথচ ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে থাকা এই পার্কগুলোর একেবারে কাছেই রয়েছে ডিএমপি’র শাহবাগ, রমনা ও কলাবাগান থানা। পার্কগুলো ঘিরে ২৪ ঘণ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল থাকলেও সন্ধ্যা নামতেই বদলে যাচ্ছে এসব পার্কের চালচিত্র। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে মাদকসেবীদের আড্ডা ও ভাসমান যৌনকর্মীদের আনাগোনা। তার সঙ্গে রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বেপরোয়া চলাচল। রয়েছে চুরি-ছিনতাইকারীদের উৎপাত। ফলে এসব স্থান দিয়ে রাতে পথচারীদের ভয়ে চলাচল করতে হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, শাহবাগ মোড় হয়ে টিএসসি পর্যন্ত পুরো পথটি ঢেকে আছে অন্ধকারে। শাহবাগ থানা অতিক্রম করলেই রমনা পার্কের প্রথম গেট। গেটের ভিতরে প্রবেশ করলেই ছবির হাট। সেখানে পাঁচ-ছয়টি ভ্রাম্যমাণ দোকান রয়েছে। দোকানের কাছাকাছি গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই গল্প করছেন, সিগারেট টানছেন। সেখানেই এককোণে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন তিন পুলিশ সদস্যও। মাঝখান দিয়ে মানুষের চলাচল। এ পথে দাঁড়িয়েই এক তরুণী খদ্দেরের খোঁজে পথচারীদের আপত্তিকর প্রস্তাব ও ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন। এর কয়েক মিনিট পর ছবির হাট পার হয়েই দেখা মেলে দেয়ালঘেরা একটি মঞ্চ। কাছে গেলেই দেখা যায় শতেক মানুষের ভিড়। সেখানে অনেকে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। তাদের বেশিরভাগই তরুণ। ওই মঞ্চ থেকে গাঁজার গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কাছে গিয়ে দেখা যায়, তাদের কেউ কেউ মাদক তৈরি করছে, তৈরি করা মাদক দলবেঁধে পার্কের অন্য স্থানে গিয়ে সেবন করছে। এর পরের দিনও সেখানে দেখা গেছে একই চিত্র। তবে এবার স্থান বদল করেছে। তাদের দেখা যায়নি দেয়ালঘেরা ওই মঞ্চে। গেটের পাশেই শাহবাগ থানার জব্দ করা গাড়ি রাখার স্থান। ঠিক সেখানে অন্ধকার থেকে একটু পর পর কয়েকজন আসছে-যাচ্ছে। কাছে গেলেই নাকে আসছে মাদকের গন্ধ। জব্দ করা ওই গাড়ির ফাঁকা জায়গায় বসে মাদক নিচ্ছে তরুণরা।

এমন দৃশ্য প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেখা যায় রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও। এসব এলাকায় রাতে প্রায়ই টহলে যান শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফ হোসেন। তার মতে, এখানে যারা আসেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থী। বাইরে থেকেও অনেক আসেন। উদ্যানের ভিতরে নানা সময় অপরাধমূলক কাজ তার চোখে পড়েছে। আরিফ বলেন, গভীর রাতেও এখানে মানুষের আড্ডা চলে। যেহেতু পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমরা ধরে নিই তারা শিক্ষার্থী। উদ্যানে যারা মাদক সেবন করে কিংবা অপরাধে জড়ায়, আমরা এলে টের পেয়ে তারা চলে যায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক আনসার সদস্য বলেন, আমাদের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব আছে, সেগুলোই পালন করি। গেটগুলোতে আমরা পাহারা দিই। রাতে গেট খুলতে রাজি না হলে অনেকে দলবেঁধে এসে গেটে লাথি মারে। এক্ষেত্রে আমরা অসহায়। আমরা চাইলেও তাদের কিছু বলতে পারি না। ছবির হাটের পাশে ১৮ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করছেন সাব্বির আহম্মেদ। তার মতে, সম্প্রতি নতুন করে বেড়েছে মাদকসেবীদের আড্ডা, চুরি, ছিনতাই আর প্রতারণা। তার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে বাইরে থেকে এসেও এসব অপরাধমূলক কাজে জড়াচ্ছে অনেকে। সাব্বির বলেন, চোর, ছিনতাইকারী ও প্রতারকরা এ স্থানটিকে নিরাপদ মনে করে। প্রায়ই দেখা যায়, তরুণ যাত্রীরা রিকশা, সিএনজি, অটো এনে চালককে ৫০০ কিংবা হাজার টাকার নোটের কথা বলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভাংতি নিয়ে যায়। তারপর সিগারেট কিনে ভাড়া দিচ্ছে বলে উদ্যানের ভিতরে গিয়ে আর ফিরে আসে না। এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। পরে টাকা না নিয়েই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে চালকরা চলে যায়। সাধারণত রাত ১১টার পর গেট আর খোলা থাকে না। এ সময় অনেকেই গেট টপকে উদ্যানে ঢোকেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিপরীত পাশে রমনা পার্ক। রাত গভীর হলেই পার্কের দেয়ালঘেঁষে জড়ো হয় একদল ভাসমান যৌনকর্মী। টঙ্গী, কামরাঙ্গীরচর ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা এখানে আসে। রাত ১১টার পর রাস্তার পাশে কাপড় টানিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয় তারা। এসব কর্ম চলে ভোর রাত পর্যন্ত। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে ওভারব্রিজে বসে থাকে অনেক যৌনকর্মী। সেখানেও চলে অপরাধ কর্মকাণ্ড। গত পাঁচ মাস ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন আনসার সদস্য বেলাল হোসেন। প্রায়ই রাতের বেলায় গার্ডের দায়িত্ব পালন করেন উদ্যানের ভিআইপি গেটে। তিনি বলেন, রাত ১১টার পর যৌনকর্মীরা আসতে থাকে এবং ভোর ৫টা পর্যন্ত এখানে থাকে তারা। রিকশা, সিএনজি, অটোচালকরাই মূলত ওদের কাছে আসে। মাঝেমধ্যে ঝামেলা হয়। পুলিশ টহলে এলেও যৌনকর্মীদের তেমন কিছু বলে না।

কারওয়ানবাজার মোড় ও বাংলামটরের মাঝখানে অবস্থিত পান্থকুঞ্জ। পার্কটি পরিত্যক্ত থাকায় মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে। এ সুযোগে রাতে সেখানে আড্ডা জমায় যৌনকর্মী, হিজড়া, টোকাই ও মাদকসেবীরা। পুরো পার্কে আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সহজেই অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

পথচারীদের টার্গেট করেই এ পার্কে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালায় তারা। তরুণদের ডেকে নিয়ে জোর করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়। পার্কের কোণায় বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। গভীর রাত পর্যন্ত এ এলাকায় রিকশা চালান মোশাররফ হোসেন। বলেন, রাত যত গভীর হয়, যৌনকর্মীদের উৎপাত তত বাড়ে। বিশেষ করে হিজড়ারা সুযোগ বুঝে মানুষ ধরে। তারা পার্কের ভিতরে প্রকাশ্যে ওত পেতে থাকে। এস আই আরিফ বলেন, অনেক তরুণ এখানে ইচ্ছে করে আসে। আবার হিজড়ারা অনেক পথচারীকে জোর করে ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতরে নিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। আমরা কিছু বললে হিজড়ারা যা মুখে আসে তা-ই বলে। তবে এমন কিছু দেখলে আমরা তৎক্ষণাৎ আইনি পদক্ষেপ নিই। ১৮ অক্টোবর রাতে এসব এলাকায় ফোর্স নিয়ে টহলে ছিলেন শাহবাগ থানার এসআই আব্দুল্লাহ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব পাশে যৌনকর্মীদের উৎপাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাস্তার আইল্যান্ড পর্যন্ত আমাদের এলাকা। রাতে যৌনকর্মীদের মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আমাদের চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালাই।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলামটর হয়ে পান্থকুঞ্জ ও রমনা উদ্যান এসব এলাকার আশপাশে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা পুলিশ টহলে থাকে। তারপরও কেন এসব অপরাধ কমছে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, এসব এলাকায় যারা মাদক সেবন করছে, তাদের আমরা গ্রেপ্তার করছি। অপরাধী তো অপরাধীই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হোক আর যে-ই হোক, অপরাধ করে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

পান্থকুঞ্জের দিকে শুধু হিজড়া নয়, যৌনকর্মীদেরও চলাচল আছে। আমাদের ফোর্স সবসময়ই থাকে এসব এলাকায়। এসব বিষয়ে প্রতিদিন আমাদের অভিযান চলে এবং সেটা অব্যাহত থাকবে বলে জানান ওসি নূর মোহাম্মদ।

জানতে চাইলে রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. আশরাফ হেসেন বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছবির হাটের গেটের দিকে যারা বসেন, তাদের বেশিরভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী। সুতরাং ঢালাওভাবে বলা যাচ্ছে না সবাই গাঁজা কিংবা মাদক সেবন করে। ওখানে মাদক সেবন করছে, এমন অভিযোগে আমরা এর আগে অনেককে গ্রেপ্তার করেছি। যে কোনো অপরাধমূলক কাজের খবর পেলে আমরা জড়িতদের তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় নিয়ে আসছি।

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ