ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

টালমাটাল এলপিজির বাজার!

প্রকাশনার সময়: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:২৩

কয়েক মাস ধরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত দাম থেকে ২০০-৩০০ টাকা বেশি দিয়ে গ্রাহকদের কিনতে হচ্ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দাম বিইআরসি কমালেও এর সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। খুচরা বিক্রেতা কিংবা ডিলার নয়, খোদ আমদানিকারকরাই মানছেন না বিইআরসির ঘোষিত নির্ধারিত দর। যেন যেমন খুশি তেমনভাবে চলছে এলপিজির বাজারদর! যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এমন টালমাটাল এলপিজি বাজারের মূলত নিয়ন্ত্রণ কর্তা কারা?

সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেয়ার কথা স্বীকারও করছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ আমদানি ও বিপণন খরচ, ডিলার খুচরা ব্যবসায়ীদের কমিশন সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। তারপরও প্রকাশ্যেই বাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে রান্নায় ব্যবহৃত অতি জরুরি এ পণ্যটি।

গত ৩ সেপ্টেম্বর ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১২৮৪ টাকা নির্ধারণ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যা আগস্ট মাসে ১১৪০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছিল। এছাড়াও ১৫ কেজি ১৬০৫ টাকা, ১৬ কেজি ১৭১২, ১৮ কেজি সিলিন্ডার ১৯২৬, ২০ কেজি ২১৪০, ২২ কেজি ২৩৫৫, ২৫ কেজি ২৬৭৫, ৩০ কেজি ৩২১০, ৩৩ কেজি ৩৫৩১, ৩৫ কেজি ৩৭৩৪, ৪৫ কেজি ৪৮১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতি মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ীর কারণে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বিইআরসি চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার তো সব কিছু বিবেচনা করে হিসাব-নিকাশ করেই পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে স্বাভাবিক মুনাফা হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তো স্বাভাবিক লাভে আগ্রহী না। বেশি লাভ করতে চায়। এখন ব্যবসায়ীদের এ প্রবণতা বন্ধ না হলে যেখান থেকে পণ্য ছাড় হয় সেখানে তদারকি করা। বিইআরসির উচিত চক্রটি যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।’

বিইআরসির ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক এলপিজি মজুতকরণ ও বোতলজাতকরণ লাইসেন্সি এলপিজি মজুতকরণ ও বোতলজাতকরণ পরবর্তী মূল্যে (মূসক-উত্তর/মূসকসহ) ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে এলপিজি বিক্রয় করবে এবং সে অনুযায়ী মূসক চালান/ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) প্রদান করবে। কোনো পর্যায়ে (এলপিজি মজুতকরণ ও বোতলজাতকরণ, ডিস্ট্রিবিউটর এবং ভোক্তাপর্যায়ে রিটেইলার পয়েন্টে) কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে এলপিজি বিক্রয় করা যাবে না।

বিইআরসি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই আমরা এলপিজি বিক্রয় মূল্যটা নির্ধারণ করছি। কাজেই মূল্য বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা যে কমিটি করেছি, তারা রিপোর্ট দিলেই অ্যাকশনে যাব। বিইআরসির কঠোর নির্দেশনার পরও গ্রাহকদের বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, ১২৮৪ টাকা দামের ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার ১৪৫০ থেকে ১৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ডিলারদের কাছে কমিশন তো দূরের কথা, সরকার নির্ধারিত দামেও তারা এলপিজি কিনতে পারেন না। ১২ কেজির সিলিন্ডার তাদের কিনতে হচ্ছে ১৪০০ টাকার ওপরে।

ক্রেতা পরিচয়ে গেলে রাজধানীর মুগদা এলাকায় খুচরা বিক্রেতা নিউ ভাই ভাই স্যানিটারির সাদেক হোসাইন জানান, ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার ১৫২০ টাকা, কোম্পানিভেদে যোগ হবে ৫০-৭০ টাকা।

সরকার নির্ধারিত দামের বিষয়ে বলা হলে তিনি বলেন, ‘১২৮৪ টাকায় তো আমরাই কিনতে পাই না। আমরাই তো ১৪ টাকার ওপরে কিনতেছি। লস দিয়া বিক্রি করুম নাকি।’ একই কথা জনালেন পাশের দোকান নুর এলপি সল্যুশনের আবুল হোসাইন।

এদিকে ডিলাররাও বলছেন একই কথা। তারা বলছেন, তাদেরই কিনতে হচ্ছে ১৩০০ টাকার ওপরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টোটাল গ্যাসের এক ডিস্ট্রিবিউটর বলেন, ‘বর্তমানে আমরা টোটালের ১২ কেজি সিলিন্ডার ১৩৫০-১৩৭০ টাকা করে পাইকারি বিক্রি করছি। টোটাল সিলিন্ডার আনতে আমাদের খরচ হয় ১৩১০ টাকা।’

ওমেরা গ্যাস ডিস্ট্রিবিউটরদের একজন বলেন, ‘ওমেরা ১২ সিলিন্ডার আনতে আমাদের খরচ হয় ১২৮০ টাকা। সেটা আমরা পাইকারি বিক্রি করছি ১৩১০ টাকা।’ একই কথা জানালেন বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ইউনাইটেডের পরিবেশকরাও।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের এ প্রবণতা বন্ধ না হলে যেখান থেকে পণ্য ছাড় হয় সেখানে তদারকি করতে হবে। বিইআরসির উচিত চক্রটি যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।

এলপিজি গ্যাস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি সেলিম খান জানান, ‘আমরা নিজেরাই এখন ১৩০০ টাকার ওপরে পে-অর্ডার করছি। বসুন্ধরা ১৩২০ টাকা, বেক্সিমকো ১৩৭০ টাকা, ওমেরা ১২৮০ টাকা; তার সঙ্গে গাড়ি ভাড়া, লেবার কস্ট, গোডাউন ভাড়া আছে। নিয়ম হচ্ছে সরকার যে রেট নির্ধারণ করে দিচ্ছে সেটার সঙ্গে ৯০ টাকা মাইনাস হবে। এটা আমার কমিশন। অর্থাৎ ১২৮৪ টাকার সিলিন্ডার আমার কাছে ১১৯০ টাকার মধ্যে আসার কথা। কিন্তু সেই এলপিজি আমাকে ১৩২০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। যেই রেটে আমি বিক্রি করব তার থেকে ৩৬ টাকা বেশি দিয়ে আমাকে কোম্পানির থেকে কিনতে হচ্ছে। তাহলে আমরা কীভাবে সেটা ১২৮৪ টাকায় বিক্রি করব?’

অপরদিকে কোম্পানিগুলো বলছে, ডলারে দাম উঠানামার কারণে প্রভাব পড়ছে এলপিজির বাজারে। এ কারণে ১২ কেজি সিলিন্ডারে ৪০-৫০ টাকা বেশি নিচ্ছেন তারা। তবে ৪০-৫০ টাকার জায়গায় গ্রাহক পর্যায়ে ২০০-৩০০ টাকার বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। বিইআরসির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন এ বিষয়ে বলেন, ‘আপনারা যে অভিযোগগুলা পাচ্ছেন আমরা তা পাচ্ছি। এসব বিষয় নিয়ে আমরা বিভিন্ন অভিযান চালাচ্ছি। আমি নিজেও গেছি নারায়ণগঞ্জে। সেখানে ডিসি সাহেবের হেল্প নিলাম। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ঠিক করে দিলেন, আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কয়েকটি দোকানকে জরিমানা করলাম। এ মাসেও গাজীপুরে অভিযান চালিয়েছি। আমার সঙ্গে এডিসি সাহেবও ছিলেন। সেখানেও জরিমানা করেছি। পাইকারি ব্যবসায়ীদেরও জরিমানা করছি। এরপরও ঢাকায় আমাদের কয়েকটা কমিটি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কোন কোম্পানি কী রকম বিক্রি করছে, এসব রিপোর্ট আমার কাছে দাখিল করছে। এগুলো আমরা কারণ দর্শানোসহ ব্যবস্থা নেব। আমরাতো ছাড় দিচ্ছি না। আমরা চাই যে মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে সেটা বাস্তবায়ন হোক।’

নুরুল আমিন বলেন, ‘আমরা গত মাসের ৭ তারিখে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মিটিং করেছি। তাদের দাবি-দাওয়া, ডালারের রেট, খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন সব বিবেচনা করেই দাম নির্ধারণ করছি। যারা ডিলার তাদের ১৯৪ টাকা ১২ কেজি সিলিন্ডারে লাভ ধরে দিচ্ছি, তারপরে যারা পাইকারি বিক্রেতা তাদের ৫০ টাকা লাভ ধরে দিলাম, খুচরা বিক্রেতাদের ৪৫ টাকা লাভ ধরে দিলাম। সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই আমরা মূল্যটা নির্ধারণ করছি। কাজেই মূল্য বেশি নেওয়ার সুযোগ নাই। আমরা যে কমিটি করেছি, তারা রিপোর্ট দিলেই অ্যাকশনে যাব।’

এ বিষয়ে দেশের একটি সুপরিচিত এলপিজি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি বলেন, ‘বিইআরসি প্রতি মাসের ১ তারিখে প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা ১ তারিখে ডলার এক্সচেঞ্জ ধরে রেটটা দেয়, কিন্তু ডলারের দাম তো চেঞ্জ হয়। আমাদের মাসে ৮-১০টা এলসি করতে হয়। এখন বিইআরসি তো ডলারের সরকারি যে রেট সে অনুযায়ী নির্ধারণ করে। কিন্তু কোনো ব্যাংকেই সরকারি ডলারের রেটে এলসি সেটেল হয় না। এর প্রভাবটা সব জায়গাতেই পড়ে। এজন্য সরকার নির্ধারিত দামে আমাদের বিক্রি করা সম্ভব হয় না। কাজেই সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে যে ৪০-৫০ টাকা ডিসটেন্স সেটা আহামরি কিছু না। সেখানে গ্রাহক পর্যায়ে ৪০-৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হতে পারে। কিন্তু সেই জায়গায় ১৫০০-১৬০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার দায় আমরা নিতে পারি না।’

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ