ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নজর ধার পরিশোধে

প্রকাশনার সময়: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:১৬

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মূল্যস্ফীতি যেন না বাড়ে এবং যে পর্যায়ে আছে— তা আরও কমাতে চায় সরকার। ফলে ব্যাংকিং খাত থেকে নতুন করে ধার নেয়া বন্ধ করেছে সরকার। ধার না নিয়ে পরিশোধ করায় ব্যস্ত সরকার। উদ্দেশ্য মূল্যস্ফীতি কমানো। বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছে দেশের অর্থনীতিবিদরা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সঠিক রাস্তাতেই আছে। সরকার গত অর্থবছরে এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে মূল্যস্ফীতি এত বাড়ত না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকার ব্যাংক খাতের ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা ধার পরিশোধ করেছে। সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৯০ লাখ কোটি টাকা। যা জুন শেষে ৩.৯৪ লাখ কোটি টাকা ছিল।

গত ২০২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ধার বাড়িয়েছিল ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে ধার বাড়িয়েছিল ১.১৮ লাখ কোটি টাকা।

মূলত মানি সাপ্লাই টাইট করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণ কমানোর পাশাপাশি পলিসি রেট এবং ল্যান্ডিং রেট বাড়িয়ে দেয়ার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী এ প্রতিষ্ঠান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন, মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেই আমরা এখন ফ্রেশ (প্রিন্টেড) মানি সরকারকে দিচ্ছি না। এর বদলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ধার করা বাড়িয়েছে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ধার কমাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ধার কমানোর পদক্ষেপকে প্রশংসা করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সঠিক রাস্তাতেই আছে। সরকার গত অর্থবছরে এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে মূল্যস্ফীতি এত বাড়ত না। দেরিতে হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন যেসব পলিসি নেয়া হচ্ছে, সেগুলো ঠিক আছে।

তিনি বলেন, অর্থবছরের শুরুর দিকে সরকারের টাকার চাহিদাও অবশ্য খুব বেশি থাকে না। তবে মনে হচ্ছে, আমরা এখন মানিটারি ও ফিসক্যাল দুই পলিসিতেই কন্ট্রাকশনারি মুডে আছি। সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সরকার। এজন্য সরকারকে এখন ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ধার বাড়িয়েছে ২৫ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ধার কমানো হয়েছে ২৯ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা।

অবশ্য একই সময়ে নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং ইন্ডিভিজুয়াল ইনভেস্টরদের মতো নন-ব্যাংক উৎস থেকে সরকার ধার করেছে ৪ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা।

ব্যাংকারদের মতে, রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে দেশের মানি মার্কেট থেকে প্রায় ৪১ হাজার ২৫০ কোটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে চলে গেছে। এর বাইরে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ধার বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার পরিশোধের কারণে টাকার লিকুইডিটি স্ট্রেস (তারল্য সংকট) শুরু হয়েছে।

এসব কারণে ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে ইন্টার-ব্যাংক কল মানি মার্কেট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার করার প্রবণতা বেড়েছে ব্যাংকগুলোর।

অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় টাকার লিকুইডিটি স্ট্রেসকে স্বাভাবিক বলে মনে করে আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, টাকার লিকুইডিটি স্ট্রেস হলে ডলারের চাহিদাও কমে যায়। ফলে, ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে।

গত অর্থবছরে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনে নেয়ার মাধ্যমে বাজারে নতুন টাকা ছেড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নতুন অর্থবছরে এ প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বদলে ট্রেজারি বিল ও বন্ডগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকে টাকার চাহিদা বেড়েছে। অর্থনীতির নিয়ম মেনে তাই সুদহারও বেড়েছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের পলিসি রেট ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে গেছে। এ রেট বাড়লে সেটা ট্রেজারি বিলের সুদ হারে প্রভাব ফেলে। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ডিপোজিটের ইন্টারেস্ট রেট (আমানতের ওপর সুদের হার) বেড়েছে বলে তাদের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন আগের মতো ট্রেজারি বিল কিনে নিচ্ছে না। পুরোটাই ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে। ফলে আগে যে রকম কম সুদহারে কাট অফ করে ফেলা যেতো, এখন সেটি করা যাচ্ছে না। এসব কারণে ট্রেজারি বিলের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেও যেখানে ৭.৪৫ শতাংশ সুদহারে ৯১ দিনের ট্রেজারি বিল বিক্রি করা হয়েছে, সেখানে সর্বশেষ ৯ অক্টোবর তারিখের অকশনে একই সময়সীমার ট্রেজারি বিলের বিপরীতে সুদ অফার করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৯.২৫ শতাংশ। অন্য মেয়াদের ট্রেজারি বিলেও সুদের হার বেড়েছে। ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৭.৬০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.৫০ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার ৮.২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.৭৫ শতাংশ হয়েছে।

সুদের হার বাড়ার কারণে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছে বলে মন্তব্য করে এ কর্মকর্তা আরও জানান, চলতি অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাইরে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছেন ট্রেজারি বিলে। এর অন্যতম কারণ, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সীমা আছে, কিন্তু ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের কোনো সীমা নেই।

ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়ে যাওয়া ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের স্মার্ট রেটকে বাড়িয়ে দেবে কিনা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, এটি নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে মাসের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ চলতি অক্টোবরে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি অকশন হয়েছে ট্রেজারি বিলের। এ মাসে আরও কয়েকটি অকশন আছে। সেগুলোতেও যদি এখনকার মতো বেশি ইন্টারেস্ট রেট থাকে, তাইলে স্মার্ট রেট বাড়বে। আর স্মার্ট রেট বাড়লে ব্যাংকগুলোর ল্যান্ডিং রেটও বাড়বে। পরিস্থিতি বিবেচনায়, চলতি অক্টোবর শেষে স্মার্ট রেট কিছুটা বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ